ekta iccha 2

মুম্বাইতে উমেশ ভাটের মত বড় মাপের প্রযোজকের ব্যানারেও বানীর হিন্দী ছবি একদম চলল না। খুব ঝড়তি দু একটা ফিল্ম ফেস্টিভেলে গেলেও কোন বড়সড় আঁচর ওই ছবি জনমানসে বা চিত্র সমালোচকদের হৃদয়ে কাটতে পারল না।

মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রি একদম একটা আলাদা জগত। বানী যে পরিবেশে, যে ভাষায় এতদিন কাজ করে এসেছে তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই। তাই টেলিভিশনেও বানী কলকাতার মত খাপ খাইয়ে নিতে পারল না। যেটুকু কাজ ছিল বানীর এই ভাষা এবং পরিবেশের মাঝে দিশাহারা হয়ে সেটুকু কাজ ও চলে যেতে সময় নিল না।

বানী পাগলের মত হয়ে গেল। এই প্রথম রেগুলার মদ খাওয়া ধরল বানী। কিন্তু উমেশ ভাট’সাবের সঙ্গে বানীর ব্যক্তিগত একটা ইন্টেলেকচুয়াল সখ্যতা বানী’কে বাঁচিয়ে দিল। উনি বানী’কে একটা প্রাইভেট ফিল্ম স্কুলে পড়াবার বন্দোবস্ত করে দিলেন।

আর মায়াব্রত? সে যেন মুম্বাই’তে নিজের মনের মত একটা জগত খুঁজে পেল। প্রেসী’র ফিজিক্স আর বন্ধু মহল ছেড়ে মুম্বাই‘তে নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়ে মাত্র মাস তিনেক লেগেছিল ওর কলকাতার ওই আড্ডা হ্যাংওভার কাটাতে।

এদিকে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক চাপে প্রথমে ভাটেদের দেওয়া লোখন্ডওয়ালা’র ফ্ল্যাট ছেড়ে আন্ধেরি ইস্ট, সেখান থেকে বোরিভালী হয়ে বানীব্রত’রা এখন মীরা রোডে এসে ঠেকলকলকাতার লব্জে বালিগঞ্জ থেকে বারুইপুর।

ওদিকে মায়াব্রত অ্যানিমেশনে দুর্দান্ত সব কাজ করতে লাগল। অ্যানিমেশনে গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজে ইউ এস যাবার লক্ষ্যে সব ভাল ভাল ইউনিভার্সিটি’তে চেষ্টা করে যেতে লাগল। স্যাট রেজাল্ট দুর্দান্ত হল কিন্তু আইভি লীগ কলেজের কেউ ফুল স্কলারশিপ দিতে রাজী হল না। প্রথম বছর নিজের পয়সায় পড়তে পারলে দ্বিতীয় বছর থেকে স্কলারশীপ। বানী স্পষ্ট বলে দিল অত টাকা দিয়ে পাঠাবার ক্ষমতা সত্যি ওর নেই। রাখী একবার আমতা আমতা করে শান্তিব্রত’কে বলার কথা বলে কি বিপদেই না পরেছিল।  

মায়াব্রত ইউ এস যাওয়ার জন্য একরকমের মরিয়া হয়ে দিনে প্রায় আঠারো উনিশ ঘন্টা কাজ করতে লাগল। রাখী একটু আপত্তি করে বলেছিল, ‘মায়া এত অনিয়ম করছিস এরপর শরীরের আর কিছু থাকবে না’মায়াব্রত মায়ের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘মা বই পড়া বিদ্যের জোর দেখে নিয়েছি, তাতে শরীর টিঁকে যায় কিন্তু অন্য আর কিছু সেই শরীরের করার উপায় থাকে না। আমার বিদ্যা আমার হাত, শ্রমিকদের মত। আমায় আটকিও না। আর দুশ্চিন্তাও কোর না। দেখবে একদিন আমি ঠিক নিজে নিজেই এই দুনিয়া সাইজ করে নেব’

এসব কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাখী পৌঁছে দেয় বানীর কানে।

সব মিলিয়ে বানী গভীর ডিপ্রেশনে চলে যেতে থাকেপ্রথমে বানী’র মনে হল মায়াব্রত মনে মনে বাবা’কে লুজার ভাবে। একসময় বানী নিশ্চিত করে ভেবে নিল মায়া ভাবে ওর বাবা’র কোন যোগ্যতাই নেই। একটা আত্মম্ভর, ব্যর্থ, অকর্মণ্য, সংসারের বোঝা সত্যি তো, ফিল্ম ইস্কুলে পড়ানোর টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া আর খাওয়া ছাড়া আর কোন কিছুই যেন হতে চায় না।  

বানী প্রায়ই গিয়ে বসে থাকতে শুরু করল মাঢ আয়ল্যান্ড ছাড়িয়ে আকসা বীচের নির্জনে।

এরকম এক নিকষ কালো সন্ধ্যায় একলা বসে মদ খেতে খেতে প্রায় সম্বিত হারাবার আগের কোন এক মূহুর্তে বানী আবিষ্কার করল ওর নিজের জীবনের অদ্ভুত একটা প্যাটার্ন।

মৃত্যু যেখানে বারংবার জীবন ফিরিয়ে দিয়ে গেছে বানী’কে।

প্রথমে বম্মা যাওয়ার পর বালাজী টকিজের অফার; ওর প্রথম সিনেমার ব্রেক।  জেঠুমনি চলে যাওয়ার পর হিন্দী ছবি’র ডেবিউ।

***

পরদিন ন’টা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গে বানীর। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। এরম’টাই তো থাকার কথা। রাখী আট’টা নাগাদ চলে যায় কাছেই একটা মন্টেসরি স্কুলে। মায়া বেরিয়ে যায় তারও আগে। বানী’র আজ এই সকালে নিজের এই বাড়ি, নিজের জীবন, নিজের এই ধীর পায়ে, একগাদা হ্যাং ওভার নিয়ে এসে বাইরের ঘরের ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়ানো, সব যেন মনে হতে থাকে একটা অন্য লোকের জীবন। এতদিন এসব যেন ও ধার করে চালাচ্ছিল, আজ সব ফিরিয়ে দিতে হবে। হাতের মধ্যে মুঠো করে ধরে রাখা ফোনটা’র দিকে একবার বানী ভাল করে তাকায়। কোন মেসেজ এসে অপেক্ষারত নয়। কোন কল বানী কে মিস করে যায় নি। ও যতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল জীবন তার একেবারে ছকবাঁধা পথেই গেছে। জীবনের কোন বাড়তি চাঞ্চল্য বানীর ফোনে অন্তত প্রতিফলিত হয় নি। বানী ফোন টেবিলে নামিয়ে রাখে। রান্নাঘর থেকে খুট একটা আওয়াজ আসে। বানী চকিতে পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে রান্নাঘরের দরজায় রাখী। বানী কিছু বলে ওঠার আগেই রাখী বলে, ‘স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্টের মা মারা গেছে.. আজ ছুটি.. তুমি সারারাত এত ছটফট করলে যে সকালে আর তোমায় ডাকিনি..’ রাখী এসে পাশ দাঁড়ায় বানীর। স্নেহ মাখা গলায় বলে, ‘যাবে একবার ডাক্তার দেখাতে? চল না.. সুগার ফাস্টিং আর পিপি করিয়ে নিয়ে যাই.. জানি তোমার কিচ্ছু হয় নি তবু..’। বানী রাখী’র পাশ থেকে একটু সরে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘মায়া? মায়া বেরিয়ে গেছে?’ রাখী আবার রান্নাঘরে ফিরে যেতে যেতে বলে, ‘তোমার ছেলে’র কি রোদ ঝড় জল বলে কিছু আছে? না সে মানে?’ বানী টেবিলে রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে কলার থোকাটা তুলে নেয় হাতে। রাখী  বলে, ‘খালি পেটে কলা খেও না.. আমি মেথি পরাঠা করছি’।

বানী তখনো কলা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যখন ফোনটা এল।

***

মায়াব্রত নিজের স্কুটি নিয়ে পৌনে আট’টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে মীরা রোড স্টেশনে সেটা জমা রেখে ৮.২০’র চার্চ গেট ফাস্ট ধরে। ওর কলেজের একদল অন্য ছেলেও ওই এক ট্রেন ধরে। এটাই ওর রুটিন। আবার রাত দশটা নাগাদ স্টেশনে নেমে স্কুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে। গত দেড় দু বছরে এই রুটিনের নড়চড় হয় নি মায়া’র।  

সকাল সোয়া ন’টা নাগাদ বানীর ফোনে মায়ার এক বন্ধুর মারাঠি মিশ্রিত হিন্দীর উদ্ভ্রান্ত বর্ণনায় বানী যেটুকু বুঝতে পারল তার মর্ম – আন্ধেরী পৌঁছনোর একটু আগে মায়া হটাত বলে ওর শরীর ভাল লাগছে না.. গা গুলোচ্ছে.. টলে টলে যায়.. সবাই মিলে ওকে দরজার দিয়ে এগিয়ে দেয় বমি যদি করে এই ভেবে। তার আগেই মায়া এলিয়ে পরে, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠতে থাকে। বানীরা যেন এক্ষুনি আন্ধেরি ইস্টে জিসাস এন্ড মেরী হাসপাতালে চলে আসে। মায়া’কে ওরা ওখানেই ভর্তি করেছে।

টাকা পয়সা জমা দিয়ে সারাদিন না খেয়ে না দেয়ে রাখী আর বানী হাসপাতালে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বন্ধুদের দু একজন যারা খুব ঘনিষ্ঠ, তারাও রয়ে গেল এবং তারাই বারবার অনুরোধ করল একটা বেঞ্চে বানীদের একটু বসতেজিজ্ঞেস করল চা এনে দেবে কিনা। সিস্টারদের কাছে নিজেরাই গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলএকসময় ওরাই এসে খবর দিল মায়া’কে ও টি তে নিয়ে গেছে। বেলা চারটে নাগাদ ডাক্তার নিজে এলেন, বললেন, ‘ইট’স আ ক্লিয়ার কেস অফ পয়েজনিং’; তবে এখন চিন্তার কিছু নেই পাম্প করে পেট থেকে সব পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। পেশেন্ট সুস্থ। ড্রিপ চলছে। পেরেন্টস একটু বাদেই ভেতরে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতে পারবেন। তবে এরকম বিষক্রিয়ার ঘটনা এলে হাসপাতাল কতৃপক্ষ আইনত বাধ্য থাকেন পুলিশ’কে সব জানাতে। এ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগীতা একান্ত কাম্য’বানী ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। ডাক্তার মারাঠি। সাদা কোটের ডান দিকে নামের ফলক লাগানো। ডঃ মাধভ পেডনেকর। বেশি বয়েস নয়। মধ্য তিরিশ। শান্ত গলায় এই কথাগুলো বলে দাঁড়িয়ে রইলেন। বানী ভেবেছিল রাখী ডুকরে কেঁদে নিজের বুকে হাত রেখে ‘মেরা বাচ্চা জিন্দা রহেগা না ডক্টর’ গোছের কিছু একটা করবে। রাখী সেসব কিছুই করল না। ডাক্তারবাবু’র শান্ত গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে খালি জিজ্ঞেস করল, ‘এইসা হুয়া কেইসে ডক্টরসাব?’ ডঃ পেডনেকর ততধিক শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, ‘ম্যাডাম ইয়ে তো আপকা বাচ্চা ঔর পুলিশ হি বাতা পায়গি’। এরপর নমস্কার করে প্রতি নমস্কার দেখার অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে মিলিয়ে গেলেন ঝকঝকে হাসপাতালের তকতকে অলিন্দ ঘুরে কোন একটা ওয়ার্ডে 

ক্রমশ

প্রথম পর্বের জন্য ক্লিক করুন

তৃতীয় পর্বের জন্য ক্লিক করুন

error: Content is protected !!