cup dish 1

এই চন্দনা কোথায় আছো? এদিকে তাড়াতাড়ি আরো দুকাপ চা দিয়ে যাও।

 ভিতর থেকে আওয়াজ এল, ‘আমি তো একটু আগেই দু’কাপ চা দিয়ে এলাম।‘

–তুমি দেখলে না সুমনা এলো।সুমনাকে মনে আছে? ঐ যে যার মা বিধবা হবার পরে তার স্বামীর একটা জামা নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াত।কারোর সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করত,‘আমার স্বামীকে দেখেছ?’

–সুমনা তুমি কি এখন কাজের থেকে এলে? তাহলে তো কিছু খাওয়া হয় নি।দাঁড়াও, আমি তোমার বৌদিকে বলছি।

‘কই গো সুমনার জন্য গোটা কয়েক গরম বেগুনি বানিয়ে দাও মুড়ি খাক, বেচারার চোখ মুখটা শুকিয়ে গেছে।’

কিছু সময়ের মধ্যেই ঘরের ভিতর থেকে আবার আওয়াজ এল,‘বেসন ফুরিয়ে গেছে, সামনের সপ্তাহে একদিন খাওয়াবো।’

–ওকে সুমনা আই অ্যাম সো সরি।তোমাকে খাওয়াতে পারলাম না। সব কথা নিজের কানেই তো শুনলে। চা আসছে, একটু অপেক্ষা কর। আসলে একটু আগেই এক রাউন্ড হয়ে গেছে। এই যে সুতপা, আর জেসমিনকে দিল।সুতপা…..,তোমাদের আর এক রাউন্ড হবে নাকি,  চন্দনাকে বলব ?

ভিতর থেকে আবার উত্তর এল,‘আর চিনি নেই। আবার আগামীকাল।’

আচ্ছা জেসমিন তোমাকে একটু আগে যে কথাগুলো বলছিলাম।আমাদের পঞ্চানন ঠাকুরের কথা জানো? শিবেরই একটা রূপ, হুগলি, হাওড়া,এই সব জেলায় পুজো হয়।ঠাকুরের পাঁচটা মুখ।এদের প্রতিটাই এক একটা প্রতীক। কেউ ধ্যানের, কেউ দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের, কেউ বা রাগের, আসলে এটাই তো আমি।লিখতে গেলে তোমাকে শুধু ধ্যান করতে হবে, আর কিছু নয়।কেন বলতো, লেখা কিন্তু একটা সাধনা। আর এই সাধনার জন্য তোমাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে, আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধব।এই আমাকে দেখ, কোথাও যাই না। লিখি,  কিন্তু কেউ পড়ে দেয় না।অনেক বড় বড় লেখকের বউরা পড়ে দেয়।একটা ‘র’ এর নিচে যদি পুটকি না পড়লেও ওনাদের চোখে ধরা পড়ে।এটাও এক রকমের সাধনা।গত কাল ‘পূর্বের সকাল’ পত্রিকা থেকে একটা প্রবন্ধ চাইতে এসেছিল। দেবো না, মুখের ওপর পরিষ্কার বলে দিয়েছি। আরে তুমি লেখকেদের অর্থ সম্মান দাও বলে লাট সাহেব নাকি, আমি কাউকে পাত্তা দিই না।তোমরা একটু বসলেই আবার ‘সবুজ বাসর’ পত্রিকার সম্পাদকের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।ও ব্যাটাও অনেক দিন ধরে গল্প চাইছে, দেবো না।গল্প কি বিক্রির জিনিস ? ভালোবাসার জিনিস। তুমি আমাকে ভালোবাসলে গল্প পাবে, না হলে না। সোজা হিসাব। এই যে চন্দনা এসো এসো, কিছু বলবে।

–এই কাপ ডিস গুলো নিয়ে যাবো?

-নিয়ে যাও। সুমনা একটু বৌদির হাতে হাতে এগিয়ে দাও।যাও চন্দনা, যাও।

চন্দনা নামের মেয়েটি এরপর শূন্য ঘরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রতিটা কাপের থেকে জল নিয়ে আলাদা একটা জায়গায় ঢেলে রেখে ফাঁকা কাপ ডিশগুলো নিয়ে ভিতরের ঘরে যাবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল এতক্ষণ ধরে কথা বলে যাওয়া লোকটা একটা চেয়ারের ওপর দুটো পা গুটিয়ে বসে আছে আর নিজের মনেই  বলে যাচ্ছে, ‘আমার কাছে গল্প নেবে, অতই সোজা কিচ্ছু দেবো না, কেন দেবো, কেন কেন?’ ওর নাম সুপ্রতীক।

চন্দনা ঘরের বাইরে বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো।গত পরশুই একটা কাপ ডিশ ছুঁড়ে ভেঙে দিয়ে মুখের ওপর বলেছে,‘এত দেরি কেন এনারা অতিথি, তোমার অপেক্ষায় বসে থাকবে, একটা ভদ্রতা নেই।’

চন্দনা কিছু না বলে ভাঙা টুকরোগুলো একটা একটা করে তুলছিল, তখনই সুপ্রতীক পিছনে দাঁড়িয়ে বলে গেল,‘ভুল হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি, আসলে দেরি করলে তো তাই..’

চন্দনা তারপরেই সুপ্রতীককে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে এল।সেকথাগুলো মনে আসতেই চন্দনা চুপ করেই কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকল।তারপর হাতের কাপ ডিশগুলো একটা জায়গায় রেখে সুপ্রতীকের কাছে গিয়ে মাথাতে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,‘কষ্ট হচ্ছে?ওষুধটা এনে দেবো?’

সুপ্রতীক তখনো চেয়ারের ওপরেই দু’টো পা গুটিয়ে অনবরত জোরে জোরে মাথা নেড়ে যেতে লাগল।চন্দনা কিছু সময় ধরে কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘জানলা খুলে  দেবো?’

-জানলা! না না খুলতে হবে না। আজ সেই সাহিত্য সভাটা আছে, সেই যে কলেজ মাঠে, আমি যাবো না বললাম। এক্ষুণি জোর করবে। জানলাটা লাগিয়ে দাও, কেউ দেখে ফেললেই মুশকিল।জোর করে নিয়ে যাবে।

চন্দনা আর কোন কথা না বলে জানলা লাগিয়ে ভিতরের ঘরে এগিয়ে যেতেই পিছনের দিক থেকে শুনল, সুপ্রতীক তখনই চেয়ারে উঠে চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিয়েছে,‘এই যে আপনারা আজ আমাকে আপনাদের মাঝে আমন্ত্রণ করে এনেছেন এতে আমি কৃতজ্ঞ……।’

রাত তখন কটা হবে, চন্দনা ঘড়ি দেখেনি।ঘুমটা ভাঙতেই বুঝতে পারল বিছানায় পাশে সুপ্রতীক শুয়ে নেই।এমন আগে অনেকবারেই হয়েছে।আগেও মাঝ রাত অবধি লিখত, বিশেষ করে শনিবার বা ছুটির আগের দিন।চন্দনার ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় শুয়ে শুয়েই লেখার ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিত, আলো জ্বললে কোন চিন্তা নেই।কোনদিন আবার লেখার ঘরে গিয়ে কথা বলে আসে।বেশিরভাগ দিনেই তারপর এসে শুয়ে পড়লেও কোনদিন আবার বলে,‘একটু দেরি হবে, তুমি যাও, আমি আসছি।’

বাথরুম গেল? কিন্তু লোকটা তো কোনদিন রাতে বাথরুম ওঠেনা।বাপ্পা বাইরে চলে যাওয়ার পরে একটু ভয়ে ভয়ে থাকে।বিশেষ করে পাশের ফ্ল্যাটের গৌতমবাবু মাস খানেক আগে মারা যাওয়ার পরে ভয়টা আরেকটু যেন বেড়েছে।কয়েকদিন আগেই রাতে শোওয়ার আগে চন্দনাকে বলে, ‘আচ্ছা ধর আমার যদি রাতে কোনদিন ঐরকম শরীর খারাপ হয়, কি করবে তুমি?’ চন্দনা সেদিন কোন উত্তর না দিলেও আজকে লেখার ঘরে আলো না জ্বলতে দেখে একটু ভয়ই পেল।বিছানা ছেড়ে নিচে নামতেই দেখল ব্যালকোনির দরজাটা খোলা।একপা একপা করে তার দিকে এগিয়ে, ‘কি গো কি হল?’ জিজ্ঞেস করতেই সুপ্রতীক কিছু সময় চুপ থেকে বলে, ‘আচ্ছা আমি যে গল্পগুলো লিখি আমি কি তাদের চরিত্রগুলোর বাবা মা?’

 –হঠাৎ একথা বলছ কেন?

একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে সুপ্রতীক।‘আজ অদিতির মা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে, আমি কেন অদিতিকে ওরকম ভাবে মেরে ফেললাম ?’

-অদিতি কে ?

-আরে তোমার সাথে সেদিন আলাপ করালাম  না।

–আমার সাথে আবার কখন আলাপ করালে ?

–এই তো সেদিন, একটা গল্প পড়ালাম না,‘তুলাযন্ত্র।’

-তাই বল, একটা গল্পের একটা চরিত্র।এগুলো সব তোমার খ্যাপামি।সব কাল্পনিক চরিত্র, তারা কিভাবে তোমার কাছে আসতে পারে?

-কিভাবে পারে তা তো জানি না, তবে আসছে।আমার কাছে প্রশ্ন করছে।সবকিছু একসাথে ভাবতে পারছি না।

–আমি কালকেই বাপ্পাকে ফোন করছি, এইরকম আজে বাজে কথাবার্তার কোন মূল্য নেই।তাও যদি নামি দামি কোন লেখক হতে, আজ পর্যন্ত তো কোন ভাল পত্রিকাতে কোন লেখা তো প্রকাশ হতে দেখলাম না। প্রকাশ তো হয় ঐ তোমাদের ভাটের লিটিল না কি সব ম্যাগাজিনে।সম্পাদকরা আসেন চা বিস্কুট খান, টাকা পয়সা নেন, তারপর ইচ্ছে হলে লেখা প্রকাশ করেন, না হলে ফুস আর ফাস।’

-যেগুলো বোঝো না সেগুলো নিয়ে কথা বলবে না।এটা অতটা সহজ নয়।যারা টাকা পয়সা খরচ করে তাদের হয়তো হুট হাট বই প্রকাশ হয়ে যায়, বা কোন পত্রিকাতে লেখা প্রকাশ করানো যায়, কিন্তু মানুষের মনে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করা খুব কঠিন ব্যাপার।

–এবং তোমার দ্বারা তা কোনদিনও সম্ভব নয়, বিয়ের আগে থেকে তো বলেই যাচ্ছ, ‘আমি এই লেখক,  আমি ঐ লেখক’ কিন্তু গুষ্টির মাথা লিখছ কি প্রকাশই বা কি হচ্ছে?’

-হবে হবে, এই সব ধৈর্য রাখতে হয়, খুব সাধনার বিষয়।

-বয়স কত হল সে’খেয়াল আছে?

-আরে তোমার কোন আইডিয়া নেই।রাজশেখর বসুর নাম শুনেছ, মানে সাহিত্যিক পরশুরাম, প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় চল্লিশ বছর বয়সের পরে, যোশেপ কনার্ড বেচারা কুড়ি বছর পর্যন্ত ইংরাজি ভাষাটাই ভালো করে জানত না।

–ঐ সব বলে কিছু হয় না।তোমার এই লেখার চক্করে বাপ্পা ঘর ছাড়ল।

-ওসব হয় হয়, জিনিয়াসদের প্রথম প্রথম কেউ বুঝতে পারে না।

-জিনিয়াস না হাতি।এই তো সেদিনও একটা খাতা জেরক্স করে একগাদা টাকা খরচ করলে,পাবলিশার্সদের কপি দিয়েও এলে। কেউ নিল? মাস তিন পেরিয়ে গেছে, কেউ একবার ফোন পর্যন্ত করল না।

-শোন ‘কুলি’, ‘আনটাচেবল’ এই সব ক্ল্যাসিক উপন্যাসের লেখক মুল্ক রাজ আনন্দের  একটা পাণ্ডুলিপি পঁচিশবার রিজেক্ট হয়ে ছিল, আর ভদ্রলোক নিজে চারবার সুইসাইড করতে গেছিলেন।আমার তো সবে তিনচারটে হল। সুইসাইড অ্যাটেম্টও করিনি।

-তোমার জ্বালায় এবার আমাকে সুইসাইড করতে হবে।

 বিয়ের পরে অবশ্য প্রথম প্রথম সুপ্রতীককে বেশ ভালো লাগত, শ্রদ্ধাও হত।একবার চন্দনার বড়দির শ্বশুর বাড়ির একজনের সাথে সুপ্রতীক বেমালুম তর্কে জিতে যায়।কোথা থেকে একটা বই এনে দেখিয়ে দেয়,‘বিদ্যাসাগরের আসল বাড়ি হুগলি জেলার বনকালীপুর গ্রামে।’ তার মুখের সামনে বলেও দেয়, ‘আপনার মত বিদ্যাসাগরের ঠাকুরদাও ঘর জামাই থাকতেন।’

অন্ধকার ব্যালকোনিতে সুপ্রতীককে ওরকম ভাবে দেখে চন্দনার দুটো চোখে বিপরীত ছবি ভেসে বেড়াতে আরম্ভ করে।এর আগে অবশ্য নিজের মনেই মাঝে মাঝে কি সব বিড় বিড় করে বকত।সেটা বাপ্পাও লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এরকম ভাবে অন্ধকারও যে কোন দিন আঁকড়ে ধরতে পারে ভাবতে পারেনি।তারপর আস্তে আস্তে পিঁয়াজের খোসার মত এক এক করে সুপ্রতীকের সব স্তরগুলো খুলে যেতে আরম্ভ করতেই চন্দনার খুব ভয় করতে লাগল। ডাক্তার দেখানোর আগে একবার বাপ্পার সাথে কথা বলতেই ওদিক থেকে কথার ঝাঁজ সহ্য করতে হয়, ‘ঠিক হয়েছে, আমি তোমাকে অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলাম, অত লেখা লেখা বলে মাথায় তুলো না, এবার বোঝ।ইট ইস অ্যান অবসেশন।তুমি ভাবতে পারো যে লোক ছেলের কলেজের গাডিয়ানডেতে ওরকম করতে পারেন তিনি সব পারেন।সেদিনের পর থেকে আমার  বন্ধুদের কাছে আমার প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকল না।বন্ধুরা পর্যন্ত আমাকে  খ্যাপাকবির ব্যাটা বলে ডাকত।তুমিও তেমন, বাইরের দেশ হলে কবে ওরকম লোককে ছেড়ে চলে আসতে।’

 সুপ্রতীকের কিছু কাজ চন্দনার নিজের ভালো না লাগলেও বাপ্পার এই সমস্ত কথাগুলো চন্দনার ঠিক ভালো লাগেনি।সুপ্রতীক একটু খেয়ালি হলেও চন্দনাকে তো কোনদিন কোন অবহেলা করেনি, যখন যা বলেছে শোনবার চেষ্টা করেছে, কিছুতে বাধাও দেয় নি।

 

ক্রমশ

দ্বিতীয় পর্বের জন্য ক্লিক করুন

                                                                    

error: Content is protected !!