শব্দ . গল্প . কল্প
দ্বিতীয় পর্ব
এক বিলেত ফেরত ডাক্তার তার রোজকার কাজে যাওয়ার পথে এই পাগলটাকে দেখত আর ভাবত এরকম একজন বুদ্ধিমান , সপ্রতিভ , সুন্দর ব্যবহারের ভাল ঘরের মানুষ পাগল হল কি করে? কারন ওনার কাজই ছিল পাগলদের সুস্থ করে তোলা। উনি আমাদের এই পাগলের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। একসময় বুঝলেন চিকিৎসা করলে একে সারিয়ে তোলা যাবে। যেই বোঝা সেই কাজ। উনি পাগলটিকে নিয়ে ওনার নিজের নার্সিং হোমে ৬ মাস রেখে চিকিৎসা করে একদম সুস্থ করে তুললেন। আরও ৬ মাস বাদে উনি ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি নাম আপনার?” লোকটি উত্তর দিল “আমার নাম বোধিসত্ব”। ডাক্তার বললেন, “বা চমৎকার নাম আপনার .. তা বোধিসত্ব কি?” বোধি একটু ভেবে উত্তর দিল, “বাদ দিন স্যর”। ডাক্তার তখন বোধিকে এক সেট নতুন জামা কাপড় কিনে দিলেন, হাতে সামান্য কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বললেন, “ব্যস এখন আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ, যান বেরিয়ে পড়ুন, সুন্দর আর সবার মতো জীবন কাটান গিয়ে।” একথায় বোধি একটু কনফিউসড হয়ে হাল্কা ঘাড় নেড়ে বলল, “আচ্ছা স্যর”। ডাক্তার বললেন, “হ্যাঁ ভাই আসুন। আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইল”। বোধি এসে দাঁড়াল রাস্তায় আর নার্সিং হোমের বিশাল দরজাটা তার পেছনে বন্ধ হয়ে গেল।
স্বাভাবিক ভাবেই বোধি ছাড়া পেয়ে সোজা চলে এল গড়িয়াহাটের মোড়ে। গায়ে নতুন জামা প্যান্ট, কোমরে বেল্ট, পায়ে জুতো, দাড়ি গোঁফের জটাজুট সব সাফ, চোখে চশমা, সুন্দর চেহারায় হাসি মুখে ও গিয়ে দাঁড়াল সেই বহু পরিচিত কচুরির দোকানের সামনে। খিদেও পেয়ে গেছিল। দোকানির অ্যাসিস্টেন্ট, আগের সেই কম বয়েসী টেনিয়াটা ওর ওই চেহারা দেখে বলল, “বলুন স্যর কি দেব? গরম কচুরি আছে নাকি পরোটা খাবেন?” বোধি অবাক হয়ে বলল, “আরে চিনতে পারছ না? আমি!” পেছন থেকে কচুরি ভাজতে ভাজতে দোকানের মালিক ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমিটা ক্যা ?” বোধি এবার আরো উৎসাহে বলে উঠল, “আরে আমি গো। ওই যে ওখানে কাজ করতাম না ? ট্র্যাফিকের কাজ। পুলিশদের সঙ্গে। চিনতে পারছ না ?” কিন্তু বোধি এখন সুস্থ হয়ে যাওয়ার ফলে সব বুঝতে পারছিল আর তাই নিজের ওই পাগলামোর কথা এর বেশি সে আর মুখে আনতে পারল না। দোকানী বিরক্ত হয়ে খেচিয়ে উঠে বললেন,” এই ভাই পয়সা আছে তো? নাহলে ফোট সালা.. এই ব্যবসার টাইমে যত্তসব..” । চা’ওয়ালাওকেও বোধি বিশ্বাস করাতে পারল না, এমনকি তাকে আর কেউ চিনতেই পারল না। সবাই ওকে স্যর, বাবু, দাদা, আসুন, আপনি, আজ্ঞে বলতে শুরু করল । সারাদিন ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের কাজ দেখল কিন্তু ভেতর থেকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ট্র্যাফিক সামলানোর কথা ভাবতেই ওর নিজের লজ্জা করতে লাগল। ফলত ও আর কিছুই করতে পারল না। দুপুর বেলা ভাতের হোটেলের সামনে ঘোরাঘুরি করল। ওকে দেখে দোকানী দ্বিগুন উৎসাহে “চিকেন মিল আছে বাউ, মাটন মিল পঞ্চাশ টাকা বাউ” বলে চেঁচাতে লাগল । পেটে আগুন খিদে নিয়ে পাশের দোকান থেকে মুড়ি কিনে কলের জল দিয়ে খেলো বোধি।
ওর কাছে এবার আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হয়ে যেতে শুরু করল। এতদিনের চেনা জগতটা এক লহমায় যেন অচেনা একটা পৃথিবী হয়ে গেল। পুলিশ সার্জেন্ট হক’দা, পাত্র’দা ওকে কেউ চিনতে পারল না। কনস্টেবলরা ওকে সসম্ভ্রমে “সরে যান স্যার লেগে যাবে” বলে মাঝ রাস্তা থেকে সরে যেতে বলল। রাতে আনন্দমেলার সামনে ওর ওই পুরনো জায়গায় শুতে গিয়ে কতগুলো ভবঘুরের সঙ্গে ওর মারপিট করতে হল। ওরা ওর সব টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিল। ওই চেহারায় ওকে কেউ নিজেদের লোক বলে স্বীকার করতে চাইল না, বিশ্বাস করল না ওই আগের সেই পাগল।
এরকম ভাবে দিন কতক অভুক্ত, অনাহারে, শুধু রাস্তার কলের জল খেয়ে কাটালো আমাদের বোধিসত্ব। ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না এই নতুন জীবনের সঙ্গে ও কি করে মানিয়ে নেবে। অথচ সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারছে এবার ওর থাকার জন্য চাই একটা বাসস্থান, বেঁচে থাকার জন্য চাই একটা চাকরি, সুস্থ হয়ে থাকার জন্য চাই সংসার, সন্তান, ভালবাসা, এটা চাই ওটা চাই, কত কিছু চাই শুধু সামান্য একজন নাম গোত্রহীন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে। যত ভাবল তত যন্ত্রনায় ওর মাথা ছিঁড়ে পড়তে লাগল। দুরন্ত গরমে, দুশ্চিন্তায়, ভয়ে ও রাস্তার মাঝখানে অচেতন হয়ে পড়ে গেল।
আর ঠিক তক্ষুনি একটা গাড়ী সময়মত ব্রেক মারতে না পেরে পিষে দিয়ে চলে গেল আমাদের বোধিকে।
সবাই হইহই করে এগিয়ে এসে মৃতদেহের পকেট খুঁজে কিচ্ছু পেল না। না কোন ঠিকানা, না মানিব্যাগ, না মোবাইল। তখন হটাত সেই কচুরির দোকানের টেনিয়া’টা বোধির মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভাল করে দেখে চিৎকার করে উঠল, ‘আরে কাকা এ তো আমাদের সেই পাগলটা গো’। এরপর সবাই ঝুঁকে পড়ে একে একে দেখে রায় দিল ‘হ্যাঁ এ সেই পাগলটাই বটে’। একজন বলল, ‘ইসস ওর এ হাল কে করল রে ? কোন গাধা ওকে এই ভাবে জামা কাপড় পড়িয়ে দিয়ে গেছে? তাই তো আমরা ওকে কেউ চিনতেই পারলাম না .. ইসস, ভেরি স্যাড.. কার একটা ভুলে ওর ভাল করতে গিয়ে ওর প্রাণটাই সে নিয়ে বসল’। সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করে সায় দিল। তারপর একসময় আস্তে আস্তে যে যার কাজে কেটে পড়ল। শান্ত হয়ে এল কোলাহল।
আর হক’দা হাঁক দিয়ে একজন কনস্টেবল কে বললেন বডি পাঠিয়ে দিতে বেওয়ারিশ লাশ ঘরে ।
গুরুপরব, ৬ই নভেম্বর, ২০১৪
গল্পcloud এর জন্য পুনর্মুদ্রিত
দেবলপুত্র গুঞ্জন
লেখক পরিচিতির জন্য ক্লিক করুন
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com