terotolay 3

“রাকা, ও কথা থাক এখন।” ওর দিকে চেয়ে রইলাম । সেই সাদা সুন্দর ড্রেসটা, যেটা সবসময় পরে থাকে ও । ছোট করে কাটা চুল, কখনো বাড়তে দেখি না । ও যে সাধারণ একটা মেয়ে নয়, সে তো আমি বুঝতে পারি । কিচ্ছু বলে না ওর নিজের সম্বন্ধে, যেটা বলে কি রকম হেঁয়ালির মতো মনে হয় । তেরোতলা…ওটা তো ধাঁধাঁ, আরো কত ব্যাপারে খটকা লাগে আমার । একদিন মা বলেছিলেন, “হ্যাঁ রে রাকা, তুই যে বলিস নিচে তোর বন্ধুরা আছে, নিচের বন্দনাদির আয়া কুসুম বলছিলো তুই নাকি ওই বাচ্চাদের খেলার পার্কের পাশে একা একা বসে থাকিস ?” আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, “একটু একা একা বসেও থাকতে পারবো না নাকি ?” কিন্তু মনে হয়েছিলো, একা-একা ? অলোকা থাকে তো সঙ্গে সবসময় । আর কিচ্ছু খায় না, চকোলেট চানাচুর আচার কিচ্ছু না, নাকি ওর সহ্য হয় না । টিভিও দেখে না না কি।

কালকের বৃষ্টিতে বেশ খানিকটা জলকাদা জমেছিলো, তার মধ্যেই দুতিনটে বাচ্চা হুটোপুটি করছিলো একটা বড়ো নীল বল নিয়ে । হঠাৎ কাদামাখা বলটা ছিটকে এলো এদিকে, আমাদের কোলের ওপর পড়লো, তারপর অন্যদিকে গড়িয়ে চলে গেলো । দুটো আয়ামাসি ছুটে এসে বলটা কুড়িয়ে নিয়ে বাচ্চাগুলোকে বকতে বকতে অন্যদিকে নিয়ে গেলো । ইসস আমার নীল স্কার্ট বেগনি টপে কাদা মাখামাখি, ঝাড়ার চেষ্টা করছি… অলোকার ড্রেসটা তো সাদা, ওর…

…ওর দিকে তাকিয়ে আমার হাত থেমে গেলো । ওর জামায় একফোঁটা কাদাও লাগেনি, তেমনি সুন্দর, সাদা, নতুনের মতো । মুক্তোগুলো একটাও খসে নি ।

“এ কি, তোমার ড্রেসে কাদা লাগে নি একটুও ।”

“না, তোমায় বলি নি ? ময়লা হয় না ।”

“অলোকা, তুমি কি বলো আমি মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না । আমরা বন্ধু, তাই না ?”

“বন্ধু।” একটু অদ্ভুতভাবে হাসলো । “কিন্তু তুমি তো আর বেশিদিন থাকবে না এখানে ।”

“মানে ? কোথায় যাবো ?”

কিছুতেই উত্তর দিলো না । আমি রাগ করলাম, তা-ও না ।

আর ক’দিন পরেই…বাবার অফিসের কে এক উচ্চপদস্থ লোক মারা গেলেন হঠাৎ । বাবাকে সেই পদটা দেওয়া হলো, বিরাট প্রমোশন, দিল্লীতে চলে যেতে হবে আমাদের । ওখানে নতুন স্কুলের বছর আরম্ভ হবে আমার । আমার মামার বাড়ির সবাই দিল্লীতেই, তাই মা দারুণ খুশী হলেন । মা আর আমি চলে যাবো কয়েকদিন পরেই, বাবা কদিন থেকে সব ব্যবস্হা করে চলে আসবেন, জিনিসপত্র সব প্যাকারেরা গুছিয়ে দেবে ।

আমি নিচে গেলাম ভারী মন নিয়ে । অলোকাকে বললাম, “তুমি সব জানতে, তাই না ।”

কিচ্ছু বললো না । আমি বললাম, “তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না ?”

“না ।”

“কেন, অলোকা ?” আমার চোখে জল এসে, গলার কাছটা ব্যথা করছিলো ।”

“ওটাই নিয়ম যে ।”

“আমি যদি কোনো সময় এখানে আসি, এই বিল্ডিংএ, তোমার সঙ্গে দেখা হবে না কেন ?”

“এটাও থাকবে না ।”

“থাকবে না মানে ? কোথায় যাবে ? তুমি, তুমি কোথায় যাবে ?”

“অন্য কোথাও ।”

ওর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, ও যেন অন্য কেউ । আমার বয়সী একটা মেয়ে নয়…এখানকার কেউ নয়, ওকে  আমি বুঝতে পারবো না । আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো ।

ও আমার হাতটা ছুঁলো, সমবেদনার কন্ঠে বললো, “দুঃখ পেয়ো না, রাকা ।এই রকমই হয় যে । তাই তো বন্ধু হয় না আমার, কিন্তু তুমি যে দেখতে পেলে আমায়, তাই…। সবাই পায় না তো ।” সামনে একটা হলুদের ওপর কমলা খয়েরী ছাপ ছাপ ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে ছুটোছুটি করছিলো । একটা মিষ্টি প্রজাপতি যেন । সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম, “তেরোতলায় কি আছে অলোকা ?”

“”সব কি বলা যায় ?”

“আমায় একটিবার দেখাবে ? নিয়ে যাবে আমায় ?”

“কেন দেখতে চাও রাকা ? ভয় পাবে তুমি ।”

“প্লীজ…আর তো দেখা হবে না, তাই না ।”

কি ভাবলো, তারপর বললো, “আচ্ছা, এসো ।”

লবিতে কেউ কোত্থাও নেই, কি আশ্চর্য । এই প্রথম লিফটে উঠলাম একসঙ্গে আমরা । প্যানেলের দিকে তাকিয়ে দেখি, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তেরোতলার বোতাম, অলোকা টিপে দিলো সেটা । পায়ের কাছে কি যেন, ওমা, সেই বেড়ালটা।

“অলোকা, যখন জ্বর হয়েছিলো, স্বপ্নে তোমার কোলে এই বেড়ালটা দেখেছিলাম আমি ।”

“তাই ?” অলোকা আর কিছু বললো না ।আমি দেখলাম বেড়ালটার চোখ দুটো দুরকম রঙের, আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে । আমি ক্রমশঃ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম । লিফটটা থামলো, দরজা খুলে গেলো,  অলোকা আমার হাত ধরে বললো , “শোনো রাকা, আমার হাত ধরে থাকবে । ভয় পাবে না । এসো ।”

তারপর…

…অন্ধকার, না অন্ধকার নয়, আলোও নয় । কতদূর, কতদূর চলে গেছে । আমরা হাঁটছি, পায়ের নিচে… মাটি, না বালি, না পাথর, বুঝতে পারছি না । কুয়াশা মাঝে মাঝে, দূরে উঁচু উঁচু কি যেন, গাছ… না বাড়ি…না অন্য কিছু… এলোমেলো হাওয়া শীষের মতো আওয়াজ, কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, কি যেন বলছে ফিসফিস করে …। অনেক দূরে খুব লম্বা একটা কালো পাথরের মূর্তি, বুঝতে পারছি আমায় দেখছে । ভীষণ ভয় করছে ।

“ওর দিকে চেয়ো না রাকা ।”

“ক্ কি, কি ওটা, অলোকা ?”

“নাম নেই । নাম হয় না”

খানিক পরে একটা দোকান, কাউন্টারে বসে একটা লোক, তেকোনা মুখ, সবুজ চোখ, ডেকে বলে, “কি নেবে দিদিমণি, সব আছে, সঅব আছে…।” অনেকগুলো ধারালো দাঁত ওর চওড়া হাঁ-তে ।

“উত্তর দিয়ো না রাকা ।”

 আবার দেখি একটা পাথরের পুরোনো কুঁয়ো, দুটো একরকম দেখতে মেয়ে, আমার থেকে ছোট, ডুরে শাড়ি পরা, জল  তুলছে । আমায় দেখে তারা হাতছানি দিয়ে ডাকে । সুর করে বলে,

“এই তো, দিদিমণি ।”

“দিদিমণি, এসো ।”

“আমাদের সঙ্গে খেলবে ?”

“খেলবে এসো !”

“জল খাবে দিদিমণি ?”

“এসো, জল খাবে ।”

অলোকা টেনে নেয় আমায় । খানিকটা গিয়ে থেমে হাত বাড়িয়ে পর্দার মতো আলোঅন্ধকারটা একদিকে টেনে সরিয়ে দেয় … আর আমি দেখি কি আশ্চর্য এক আলোঝলমল জগত । নিচে গালচের মতো সবুজ ঘাস আর অনেক রঙীন প্রজাপতি উড়ছে, না প্রজাপতি নয় তো, ফুল, না, বদলে আবার প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে । অলোকা আবার সরিয়ে দেয় সেটা । একটা উপত্যকা, কতো ফুল, পাঁচটা করে পাপড়ি পাঁচরকম রঙের, রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে আর পাপড়িগুলো স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, কি অসহ্য সুন্দর…আবার একটা সমুদ্রের ধার, চিকেচিকে বালিতে নীল ঢেউ এসে পড়ছে আর টুকটুকে লাল কি ফল যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে, পিঠে ডানা-লাগানো ছোট্ট ছোট্ট সোনালী হরিণ সেগুলো খাচ্ছে…আবার অন্য দৃশ্য, দূরে একটা সাদা মন্দির থেকে রূপোলী শব্দে ঘন্টা বাজছে, সামনের রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা করে চলেছে কতো মানুষ, অদ্ভুত লম্বা পোশাক তাদের আর হাতের পাত্র থেকে সুগন্ধি ধোঁয়া উঠছে…

অলোকা বললো, “আর না, রাকা, তুমি আর পারবে না ।” আবার আলো অন্ধকার আর এক পলকে দেখি আমরা দুজনে আবার সেই বেঞ্চিটায় বসে আছি । সামনে সেই প্রজাপতির মতো মেয়েটা তখনো খেলছে । কোনো সময় কাটে নি যেন । আমি হাঁপাচ্ছিলাম, বললাম, “ওসব কি ছিলো, অলোকা ? ও সব আছে সত্যি ?”

“আছে তো । ওরকম অসংখ্য আছে । আবার নেই-ও । আর প্রশ্ন করো না রাকা । তুমি বুঝবে না এখন ।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম । “সত্যি আর দেখবো না তোমায়?”

“না । কিংবা…হয়তো কখনো…।” হঠাৎ আমার গালে চুমো খেলো । “যাও এবার রাকা, লক্ষ্মী মেয়ে । আর এসো না এখানে ।”

আমি খানিকটা এগিয়ে ফিরে দেখলাম, বেঞ্চিতে কেউ নেই ।

তার ক’মাস পরে, দিল্লীতে আমাদের নতুন বিরাট কোয়ার্টারে একদিন ফোনে আমার এক বান্ধবীকে টেক্সট করছি, এমন সময় বাবা ডাকলেন, “রেখা, রাকা, দেখে যাও টিভিতে কি দেখাচ্ছে ।”

কলকাতার দৃশ্য । আমাদের সেই কুড়িতলা আবাসনটাতে বিশাল সব ফাটল ধরেছিলো । হেলে পড়েছিলো । তাড়াতাড়ি সব লোকজনদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের জিনিষপত্র শুদ্ধ । সরকারের আবাসন তাই কারো ওনারশিপ নয়, কারো আর্থিক ক্ষতি হয় নি । ভেঙে ফেলা হচ্ছে ।

মা বললেন, “কি কাণ্ড । ঐখানেই থাকতাম…বাপ রে ! কি অদ্ভুত ব্যাপার, বল, রাকা !”

আমি টিভির দিকে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে বললাম, “হ্যাঁ । খুব…অদ্ভুত ।”

(সমাপ্ত)

তেরোতলায় – প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

তেরোতলায় – দ্বিতীয় পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

Profile Tandra Banerjee

তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতির জন্য এখানে ক্লিক করুন

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!