terotolay 2

ঘুম ভেঙে উঠে মনে হলো এতো স্পষ্ট স্বপ্ন আমি আগে কখনো দেখিনি । কিন্তু খুব মিষ্টি, আমি নিজের মনেই একটু হেসে বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো আমার বাঁ দিকের গালের নিচে যেন সূক্ষ্ম একটু আবিরের গুঁড়ো । হাতটা মুখে ছোঁয়াতে একটা হাল্কা গন্ধ…কিসের…আমের ? দূর, সব কল্পনা । মুখে জলের ঝাপটা দিলাম।

সেদিন নিচে গিয়ে দেখলাম অলোকা বসে আছে , হাতে একটা কি যেন নিয়ে তার ওপর ঝুঁকে । কাছে একটা রঙীন সুতোর গুলি বলে মনে হলো । আমায় দেখে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো সেটা ।

“কখন এলে তুমি ?”

“তুমি এলে, তাই আমিও এলাম ।”

ও কালকের সেই ড্রেসটাই পরে আছে, সাদা, সিল্কের না মখমলের বোঝা যাচ্ছে না, মনে হয় খুব নরম আর দামী । খুব সুন্দর সূক্ষ্ম কারুকার্য করা, ডিজাইনটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট মুক্তো বসানো । ড্রেসের স্টাইলটা পুরোনোও নয়, আবার মডার্নও নয়, কেমন যেন অন্যরকম । আমি বললাম, “তোমার ড্রেসটা খুব সুন্দর কিন্তু, কোথায় কিনেছো গো ?”

“কেনা যায় না ।”

“তৈরি করিয়েছো বুঝি । তুমি কালকেও এটা পরে ছিলে না ?”

“পরে থাকি তো । এটা আমার পোশাক কিনা, তাই ।” কি যে অদ্ভুত কথা বলে এক এক সময় ।

“কিন্তু ময়লা হয়ে যাবে তো…ধুতে হবে ।” ওই একরকম অনেক জামা আছে নাকি ওর !! তাই হয় নাকি !

“হবে না । হয় না ।”

“ইস আমি ভীষণ জামা ময়লা করি আর ছিঁড়ি, মা যা বকেন ! অলোকা, তোমার বাড়িতে কে কে আছেন বলো নি কিন্তু ।” একটু ভাবলো, তারপর বললো “আছে, আবার নেই-ও । কখনো কখনো আছে ।” কথাটা বিশেষ বুঝলাম না । আবছা ভাবে মনে হলো হয়তো অলোকার তেমন কেউ কাছের নেই । যাদের কাছে থাকে তারা হয়তো ওর আপন নয়… সেইজন্য ও নিজের কথা বেশি বলতে চায় না । হয়তো বাড়িতে পড়াশোনা করে ।থাক, আর জিজ্ঞেস করবো না বেচারাকে ।

স্কুলের গল্প করলাম, বই পড়তে ভালোবাসি সে কথা বললাম । অলোকাও বই পড়ে খুব, আমি যে বই পড়েছি, আশ্চর্যভাবে ও-ও পড়েছে । আর ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম ও পড়াশোনাও বেশ বোঝে । আমি অ্যালজেব্রার একটা অঙ্ক বুঝতে পারছিলাম না আজ,  ক্লাসে বকুনি খাচ্ছিলাম । মোবাইল বার করে দেখালাম ওকে । একটু হেসে আমার হাতটা ধরলো, খুব ঠাণ্ডা হাতটা, তারপর বললো, “আবার পড়ো তো অঙ্কটা।” আমি তাকালাম মোবাইলের স্ক্রীনে আর অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো – আমি অঙ্কটাকে যেন কেমন স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমার চোখের সামনে, জড়িয়ে যাওয়া একটা সুতোর জাল যেন খুলে যেতে লাগলো আর সমাধানটাকেও পরিষ্কার বুঝতে পারলাম । হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, “ঠিক আছে ?”

“কি করে হলো… অলোকা ?”

“তোমার মনের ভেতরেই ছিলো । আমি দেখিয়ে দিলাম শুধু ।”

সেদিন মা বললেন, “আজকাল তো নিচে যাস রোজ রোজ…বন্ধু টন্ধু হয়েছে বুঝি ?” আমি ভাসা ভাসা ভাবে, “হ্যাঁ.. ওই আর কি” বলে এড়িয়ে গেলাম । মা বাবা কাজে খুব ব্যস্ত থাকেন আজকাল আর মোহনাদিদি কারো সাতে পাঁচে নেই । অলোকা বারণ করেছে ওর কথা কাউকে বলতে, আমিও কেমন একটা বাধা বোধ করি ওর কথা উল্লেখ করতে ।

একদিন বললাম, ”তুমি কতোদিন আছো এখানে – আগে কোথায় ছিলে ?”

“অনেকদিন, আবার অন্য জায়গাতেও, সব জায়গাতে…।”

“অনেক জায়গায় ঘুরেছো বুঝি ?” আমি উৎসাহিত হলাম, “তোমার বাবার ইয়ে মেসোমশায়ের বদলির চাকরি ছিলো নিশ্চয়ই ?” কিছু না বলে বাচ্চাদের দিকে চেয়ে রইলো ।

“আমি তেমন কোথাও যাই নি জানো, বলো না তোমার বেড়ানোর গল্প ।”

একটু চুপ করে থেকে বলতে আরম্ভ করলো আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলাম । অলোকা বললো কত পাহাড় সমুদ্র নদীর কথা, জলপ্রপাত আর মরুভূমি, গহীন বর্ষারণ্য আর আশ্চর্য মেরুপ্রভা । এগুলোর নাম শুনেছি, বইয়ে পড়েছি আর টিভিতে দেখেছি, কিন্তু ওর কথায় যেন, আক্ষরিক অর্থেই,  ও-সব দেখতে পেলাম, সামনের বাস্তবটা মুছে গিয়ে । আবছা ভাবে মনে হতে লাগলো, এটা কি সম্মোহন? কি করে সম্ভব…তার পরেই আমি আবার ওর পাশে বেঞ্চে বসে, ও আমার দিকে ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে ।এই যাদু আমি এড়িয়ে যেতে পারবো না । আমি  বললাম, “তুমি এতো জায়গায় গেছো ? কি করে গেলে ?” ও অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললো, “আমারও কোনো বন্ধু হয় না জানো । তোমায় দেখে ইচ্ছে হলো।”

খুব খুশি হয়ে বললাম, “আমাদের বাড়ি যাবে একদিন ?”

মাথা নাড়লো, “না । যেতে নেই ।”

“আচ্ছা তোমার মোবাইল নম্বরটা আমায় দাও তো । রোজ ভুলে যাই চাইতে ।”

“মোবাইল নেই । আমাদের – আমার – দরকার হয় না ।”

“অলোকা, তুমি সত্যিই তেরোতলায় থাকো ?”

“তেরোতলায় ।”

এমনি ভাবে দিন কাটতে লাগলো । অলোকা যেন আমার সত্ত্বায় জড়িয়ে গেলো, কিন্তু কি যেন রহস্যে ঘেরা, ওর কথা কাউকে বলতেও পারি না, আর চাইও না । যেন আমার গোপন কথা ও।কতো অদ্ভুত, আশ্চর্য কথা বলে ও।

একদিন বিকেলে মেঘলা করে এলো । আমি একটু তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে দেখি, অলোকার হাতে সেই রঙ-বেরঙের  সুতোর গুলিটা, কয়েকটা সুতো আঙুলে জড়িয়ে কি যেন করছে । আমি বললাম, “তোমায় হ্যালো বলতে এলাম । আজ চলে যাবো এক্ষুণি, একটা বিয়ে বাড়ি যাবো আমরা । গিয়ে তৈরি হতে হবে । বাবার কোন এক দাদার ছেলের বিয়ের বৌভাত ।”

অলোকা আমার দিকে একবার দেখে আঙুলের সুতোর জালটার দিকে তাকিয়ে রইলো । তার পর মুখ তুলে আমার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকালো ।

“রাকা ?”

“কি ?”

“রাকা, যেও না ।”

“মানে ?”

“ওখানে যেও না ।”

কিন্তু কি করে … মানে যাবো না কেন, মা’দের সঙ্গে যেতে হবে তো…আত্মীয় হয় ওরা…কি যেন জ্যাঠা…।”

ও উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, “তোমায় যেতে হবে না ।” তার পর হাত বাড়িয়ে আমার কপালটা একবার ছুঁয়ে দিলো, আগে একবার যেমন দিয়েছিলো । শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠলো । আমি কোনোক্রমে বললাম, “আসছি” । লিফটে উঠে বুঝলাম মাথা ঘুরছে, একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা…একটা ঘোরের মধ্যে লিফটের বোতাম টিপতে  গিয়ে দেখি, এই তো, ১২র পরে দেখা যাচ্ছে ১৩, আছে তাহলে…না আগে বাড়ি যাবো । মোহনাদিদি দরজা খুলে দিয়ে আমায় দেখে চমকে উঠলো, আমায় ধরে ফেলে মা’কে চেঁচিয়ে ডাকলো । মা ছুটে এলেন, বাবাও, নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন । “উঃ গা পুড়ে যাচ্ছে…চোখ তো লাল হয়ে গেছে…কখন এলো এতো জ্বর…এই তো ঠিক ছিলো…বৌদি সরো দেখি একটু মাথাটা ধুইয়ে দিই …।” আর আমি বিড় বিড় করছি, “মা জানো, তেরোতলা আছে, আছে ।” মা প্রায় কেঁদে ফেলেছেন, আর বাবা বলছেন, “ডাক্তার ঘোষের চেম্বার বোধহয় খোলা আছে, ফোন করে দেখছি ।”

সারারাত জ্বরের ঘোরে এপাশ ওপাশ করলাম, আর এলোমেলো স্বপ্ন । দেখলাম শুয়ে আছি একটা বিশাল ঘরে একটা পালঙ্কে, ছাদ দেওয়াল কিছু দেখা যাচ্ছে না, একটা কুয়াশা, আমার পাশে অলোকা বসে, ওর কোলে একটা পাটকিলে রঙের ডোরা কাটা বেড়াল । অলোকা আমার মাথায় ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, “সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো ।” আমি বললাম, “এটা কি জায়গা ?” ও বললো, “কেন, তেরোতলা!”

পরের দিন যখন ঘুম ভাঙলো, তখন অনেকটা বেলা। মা পাশে বসেছিলেন, “এই তো ঘুম ভেঙেছে । জ্বরটাও নেই, বাব্বা কি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, আমরা জেগে সারা রাত… । মোহনা একটু গরম দুধ করে আনো তো… আবার ট্যাবলেটটা দিতে হবে।”

বাবা ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন, এদিকে আসতে আসতে বললেন, “রেখা, ওদিকে কি কাণ্ড । হিরণদাদের বাড়িতে…”

“কি হয়েছে ?”

“ওই ঝড় বৃষ্টিতে…প্যাণ্ডেল ভেঙে পড়েছিলো… অনেকে আহত রয়েছে…কেউ কেউ হাসপাতালে…একটা বাচ্চার মাথায় খুব লেগেছে, বাঁচবে না হয়তো …কোন এক মহিলার পায়েও…।”

“ইসস । দেখি কাগজটা, আজ তো টিভিতে খবরটাও দেখা হয় নি..”।

ওঁরা কথা বলতে লাগলেন উত্তেজিত হয়ে, আমি চুপ করে শুয়ে রইলাম ।

দুদিন আমাকে কেউ নিচে যেতে দিলো না । জানলা দিয়ে দেখতাম, বেঞ্চটা খালি । তারপর নিচে গিয়ে দেখি, অলোকা বসে আছে ।

“তুমি জানতে আমি নিচে আসবো আজ ।”

“জানতাম ।”

“অলোকা…আমার জ্বরটা…ওখানে প্যাণ্ডেলটা ভেঙে পড়েছিলো, আমি গেলে…তুমি আগেই…।” অসংলগ্নভাবে বলে থেমে গেলাম ।

(ক্রমশ)

তেরোতলায় – তৃতীয় পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

তেরোতলায় – প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন

Profile Tandra Banerjee

তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতির জন্য এখানে ক্লিক করুন

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!