শব্দ . গল্প . কল্প
আমাদের প্রজন্মের কারো, মানে ষাটের দশকের মধ্য বা শেষভাগে জন্মানো মানুষদের, চুনী গোস্বামী’র খেলা কোনদিন গ্যালারীতে বসে দেখার সৌভাগ্য হয় নি। সৌভাগ্য হয় নি দু পায়ে সমান শক্তিধারী, গোলপোস্টের পেছনের জাল ছিঁড়ে দেওয়া, গোলার মত শটে গোল করার মালিক পিকে অথবা এই দুই লেফট আর রাইট উইয়িং এর মাঝে থাকা সেন্টার ফরোয়ার্ড, যাদুকর বলরাম এর দু পায়ের কাজ দেখা।
কিন্তু ফুটবল নামক কলোনিয়াল এই খেলা সেই যে ১৯১১ সালে মোহনবাগান বাঙ্গালীর পায়ের সামনে নামিয়ে নিয়ে এল সেই ট্র্যাডিশন এনারা বহন করে পঞ্চাশের দশকে খেলাটাকে এনে ফেললেন সদ্য স্বাধীন এবং ভয়ানক ভাবে দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষের যুবকদের মনে প্রাণে। অন্ন নেই, বাসস্থান নেই, চাকরি নেই – সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার সময়ে চুনী – পিকে- বলরাম বাঙ্গালী যুবকদের আলো দেখালেন। দেখালেন ফুটবল খেলে চাকরি পাওয়া যায়, ভালভাবে বেঁচে থাকা যায়, পরিবার কে বাঁচিয়ে রাখা যায়, বোনের বিয়ে দেওয়া যায় আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উত্তাল, যে কোন মুহুর্তে ভেঙ্গে পরতে পারে এমন পলকা কাঠের মচমচে এক গ্যালারি ভর্তি দর্শকের সামনে, বিপক্ষের গোলরক্ষক’কে পরাস্ত করে গোলে বল ঠেলে গোললাইন পার করে দেওয়ার পর যেটা পাওয়া যায়, সেটা কোটি টাকা দিলেও অন্য কোন পেশায় পাওয়া যায় না – সমর্থকদের লাগামছাড়া ভালবাসা, হাড়হীম করা আতিশয্য আর অকল্পনীয় আদর। সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা।
চুনী – পিকে – বলরাম – অরুণ ঘোষ – অরুময়নৈগম এবং আরও কত শত শত ফুটবলার, বাঙ্গালীর নয়নের মণি, যাদের তৈরি সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। বাঙ্গালী আজও ফুটবল অন্ত প্রাণ। ‘সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল’। এখনো ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান মানে লাখো বাঙ্গালী যুবকের হৃদয়ের দোলা, আবেগ আর চোখের জল। এখনো মনোরঞ্জন – সুব্রত – গৌতম সরকার – সমরেশ – সুরজিত – অলক ভট্টাচার্য – বিশ্বজিত – কৃশানু – বিকাশ হয়ে মেহতাব হুসেন, দ্বিপেন্দু বিশ্বাস সেই চুনী – পিকে- বলরামদের ট্র্যাডিশনের ফসল।
সেই সেরা খেলার সেরা রূপকারদের একজন সুবিমল ‘চুনী’ গোস্বামী, আমাদের ছেড়ে গতকাল জীবনের খেলা সাঙ্গ করে ফুটবলের ভগবানের ড্রেসিং রুমে ফিরে গেছেন।
অধুনা ঢাকার কাছে কিশোরগঞ্জে চুনী গোস্বামীর জন্ম। ৮ বছর বয়েসে মোহনবাগানের জুনিয়র হয়ে ক্লাবে আসেন, বড়দের দলে খেলার সুযোগ পান ১৯৫৬ তে এবং খেলোয়াড় জীবনে মোহনবাগানের এই সঙ্গ উনি শেষদিন পর্যন্ত ছাড়েন নি [এই লাইনটা লিখে হাল্কা চোখের জল মুছে নিলাম; আহা এক দু বছর ইস্টবেঙ্গলের ওই আগুন ঝরানো জার্সী গায়ে দুটো গোল মোহনবাগান’কে ঠুকে দিলে যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত] যাক গে।
উনি ফুটবলে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে একে একে চাইনীজ ওলামপিক্স টীম’কে হারালেন, এশিয়া কাপ, মারডেকা কাপ জিতলেন এবং ‘৬২’র এশিয়ান গেমস এ সোনা এবং জিতলেন। সেই প্রথম এবং আপাতত শেষ। ফুটবলের এই আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় ৫০ টি গোল করে ভারতের মানুষের মাথা উঁচু করে দিলেন। তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশের জনমানসে এই কৃতিত্বের প্রভাব আজ আমরা এই হাতের মুঠোয় চলে আসা প্রথম বিশ্বের বহু সুযোগ সুবিধার মধ্যে বসে কল্পনাও করতে পারব না। ফুটবলের এই সোনার যুগ আমরা সবাই আবার ফিরে পেতে চাই কিন্তু আদৌ পাব কি? এই প্রশ্নের মীমাংসা যতদিন সবুজ গালিচার মত মাঠে সাদা কালো ফুটবলে লাথি পরবে ততদিন আমাদের, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বা তারও পর আরো কয়েক প্রজন্মকে অপেক্ষা করে থাকতে হবে। সঙ্গে লাগবে চুনী – পিকে- বলরামদের ঐতিহ্য স্মরণে রাখা।
চুনী গোস্বামী সেই অসাধারন প্রতিভাবানদের একজন যিনি ফুটবলের সঙ্গে সমান তালে ক্রিকেট ও খেলেছেন। বাংলা কে রঞ্জী ট্রফিতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৭২ – ৭৩ এই ক্রিকেটিং সীজনে উনি ৪৬টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলে ১৫৯২ রান করেন ও ৪৭ টি উইকেট পান। তখন ফুটবলে বাংলার মত বম্বে [এখন মুম্বাই] ছিল ক্রিকেটের মক্কা। চুনী গোস্বামীকে তখন হয়ত সেই কারনেই বারবার বম্বের সেই ক্রিকেটীয় বিক্রমের সামনে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে। কারন পরিসংখ্যান বলছে ৭০ থেকে ৭৩, যে সময়ে বম্বে ভারতের ক্রিকেটে একচেটিয়া শক্তি ঠিক সেই সেই সময়ে ফুটবলে বাংলা। একমেবাদ্বিতীয়ম । সবাই তখন বাংলার ফুটবল শক্তির সামনে বারবার মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। বম্বে পর্যন্ত। পরে যারা মহারাষ্ট্র হয়ে সন্তোষ ট্রফি খেলেছে।
আজ চুনী গোস্বামীর চলে যাওয়া এই বর্ণময় ইতিহাসে একটা যতিচিহ্ন।
ওনার আত্মা চিরশান্তি পান।
অথবা আমার মত ফুটবলপ্রেমী মানুষেরা চাইব উনি বারবার ফুটবলার হয়ে এই বাংলায় ফিরে আসুন। আমরা হৃদয়ে রাখব ওনাকে। যেমন রাখব ওনার এই জীবনের স্মৃতি, আজীবন, আমাদের একান্ত ভালোবাসার আসনে। একনিষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল প্রেমী, সমর্থক হয়েও। ফুটবল উদার হতে শেখায়। চুনী গোস্বামীর মত মানুষের থেকে সেটাও শিখেছি।
দেবলপুত্র গুঞ্জন
লেখক পরিচিতির জন্য ক্লিক করুন
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com
This website has been developed on WordPress by Red Panda Digital Creations.