শব্দ . গল্প . কল্প
‘তান্ত্রিক শিখা রাণী ‘ এখানে যাদু, টোনা, বান মারা হয়। এরকম একটা দেয়াল পোস্টারের সামনে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিলো। বড় গোল ফ্রেমের চশমা, কোঁকড়ানো চুল কোনমতে ছোট হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। তারপর ও অবাধ্য চুলগুলো মেয়েটার আঙুলের শাসনকে তোয়াক্কা না করেই উড়ছে। আমি ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে আনমনে দৃশ্যটা দেখছিলাম। দেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকতাম, যদি না মেয়েটা আমায় ডাক দিতো। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে মেয়েটা বলল,’ এই যে ভদ্রলোক, ফোনে ব্যালেন্স আছে?’
না তো।
উফ! দাঁতে ঠোঁট আরো শক্ত করে কামড়ে ধরলো। ব্যালেন্স না থাকায় বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার ফোনে কখনো ব্যালেন্স থাকেনা। আসলে লাগেনা বলতে গেলে।গত দুই বছর হলো প্রেমিকার বিয়ে হয়েছে, তারপর থেকে দেখি আমার আসলে ফোন দেওয়ার মতো তেমন কেউ নাই। যারা আছে তাদের সাথে কথা বলার জন্য রেগুলার ব্যালেন্স লাগেনা। বাসায় থাকলে সারাদিন ক্যাও – ম্যাও। এতবড় ছেলে, আর কতদিন বসে খাবি! সুতারাং আমি দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছি।
আনমনে পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম খুচরা কিছু আছে । আমি গলা পরিষ্কার করে বললাম, ‘মিনিট খানেক ওয়েট করতে পারবেন? ‘
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে, দেয়াল পোস্টারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিড়বিড় করে পড়ে বলল, ‘ পারবো। ‘
আমি জানিনা সে কাকে যাদু টোনা করার জন্য ফোনের ব্যালেন্সের জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি টের পাচ্ছি আমার খুচরা পয়সা দ্বিধাহীন ভাবে ফোনের ব্যালেন্সের জন্য খরচ হয়ে যাচ্ছে অথচ এটা দিয়ে আমার গোল্ড লিফ টানার কথা! হায় আল্লাহ, আমার সিগারেটের টাকা… এভাবে সিগারেট এর টাকা খরচ করে কারো যাদু – টোনার কৌতূহল মিটাতে গিয়ে আমার অমিত্রাক্ষরের সাথে পরিচয়।
কার যেন এ মনের বেদন…দুঃখিত আমি একদমই রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারিনা কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় আমি চাইলে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারতাম! হাস্যকর ভাবনা না? ভাবনাটা এরকম হয়ে যায় অনেকটা – আমি চাইলে বিমান চালাতে পারতাম ! জানি হাস্যকর ভাবনা এবং চাপাবাজ হিসেবে নিবেন আপনারা। কিন্তু অমিত্রাক্ষর মোটেও হাসেনি। ঠিক এই জায়গায় আপনাদের সাথে অমিত্রাক্ষরের পার্থক্য। ও চোখের ভ্রূ সিরিয়াস করে বলেছিলো, ‘ দাঁড়ান, রেকর্ড করি। ‘
আরে কি যে করো, আমি এমনেই গাইছিলাম। তোমার সবটাতে বাড়াবাড়ি ।
মোটেও বেশি করছিনা আমি। আপনি আবার শুরু করুন। আমি ফোনের রেকর্ড অন করছি।
হুস, পাগলি আছো তুমি ।
আপনাদের কি মনে হয়, এরকম মেয়ে প্রতিদিন জন্মায়? নাহ্, এ ক্ষণজন্মা। এদের দেখা ফুটপাতে পকেটে খুচরা টাকা – পয়সা গুণতে গিয়ে পাবেন আপনি।
আচ্ছা, তোমার নাম এমন কঠিন কেন? অমিত্রাক্ষর! দাঁত – টাত ভেঙে যাওয়ার অবস্থা । ছোট করে অমি বা অমিত্রা ডাকার ব্যবস্থা নেই ?
কেন? খুব কঠিন! অ ডাকেন তাহলে।
থাক, অমিত্রাক্ষর এই স্বর অ ডাকার চেয়ে ঢের ভালো।
এরকম অর্থহীন অথচ অকারণ বকবক অমিত্রাক্ষরের সাথে আমার হতো। ঠিক দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি সময়টা অমিত্রাক্ষর বেছে নিতো।আমিও সময় দিতাম, আমার রিফ্রশমেন্টের জন্য । চাকরি খুঁজতে খুঁজতে যখন মনে হতো পিকেটিং করা এরচে সহজ, শুধু হরতালের সময় এক্টিভ থাকলে হবে। এই যখন মানসিক অবস্থা , তখন অমিত্রাক্ষরের সঙ্গ আমার জন্য এক ঝলক বাতাস।
আপনার আইডিয়াটা কিন্তু বেশ, পিকেটিং এর।
তাই বুঝি?
অমিত্রাক্ষর মাথা নেড়ে হাসত কেবল। ওর হাসিটা সত্যি সত্যি ল্যুভর মিউজিয়ামে বিক্রির মতো। ভিঞ্চি সাহেবকে যদি দেখাতে পারতাম!
সবকিছু চাইলেই হয়না, তাই ওর হাসিটা ভিঞ্চি সাহেবকে দেখাতে পারলাম না। কিন্তু আমি দেখতাম ঘোর লাগা দুপুরময় বিকেলে। কত অনর্থ কথা যে মেয়েটার। অথচ এই মেয়ের চেহারা দেখলে কে বলবে ও এত কথা বলতে পারে!
আটাশ বছরের একজন যুবক চাকরির খুঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আবিষ্কার করলো সে হুটহাট রিলাক্স করার দিনগুলোতে বাইশ বছরের অমিত্রাক্ষরে মজে যাচ্ছে । একদম তলিয়ে যাওয়ার পর্যায় আরকি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, কারণ আমার বলার মতো তেমন কথা নেই। এরচে বড় কথা ওর কথার বা কাজের তাল খোঁজা অসাধ্য।
একদিন চোখ -মুখ সিরিয়াস করে বলছে,’ অনিক সাহেব আমরা অনেক জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু দেখি না ।‘
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘ আমি তোমার বেশির ভাগ কথাই বুঝি না। সহজ করে কথা বললে কি হয়। ‘
থাক, বুঝতে হবে না। এই বলে ঘাসে পড়ে থাকা স্পিডের বোতল কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখতে রাখতে বলল,’ সজীব প্রকৃতিতে এক নির্জীব বস্তু পড়ে আছে, যার নাম স্পিড! ‘প্রায় মিনিট কুড়ি পড়ে বুঝতে পারলাম কোন অর্থে সে কি বলেছে ।এই হলো আমার মাথার ঘিলুর অবস্থা। এরকম বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে আমার কপালে থাকবে আমি আশা ও করি না। তারপর ও তো মানুষ আশা করে, তাই না?
শেষ অবধি কি হয়েছিল জানেন? বলতে ইচ্ছে করছেনা কিন্তু গল্প যখন শুরু করেছি শেষ তো করতেই হয়। আমি একদিন হাঁটু ভেঙে মোটামুটি ফিল্ম কায়দায় বলার চেষ্টা করেছিলাম, ‘ কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি.’.. তারপর আর বাকিটা বলতে পারিনি, মাথা এমন চুলকাতে লাগলো যে মনে হবে কুশকিতে মাথা গিজগিজ করছে। যাইহোক আমাকে পুরোটা কষ্ট করে বলতে হয়নি, বুদ্ধিমতী তো বুঝে নিয়েছিলো।
কিন্তু নির্মম রসিকতাটা ঈশ্বর আমার সাথে করলো। সব সুখ বোধহয় সবার কপালে সয় না, নয়তো পেয়েও হারাতে হয়! ঠিক যখন মুঠো বন্দী করে ধরতে চেয়েছিলাম তখনই মুঠো আলগা হয়ে গেলো। সাধারণ পরিবহন লেখা একটা ট্রাক অসাধারণ অমিত্রাক্ষরের পা দুটোকে গুড়িয়ে দিলো। কি ভাবছেন আপনারা ? আমি কাপুরুষ! অমিত্রাক্ষরকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি? নাহ্, কাহিনী বরং উল্টোটা। হুইলচেয়ারে বসে অমিত্রা আমায় সেদিন বলেছিলো, ‘ আমি তো আজন্ম দুপুর তোমার সাথে হাঁটতে চেয়েছিলাম। ‘ এরপর আমি অনেক বুঝিয়েছিলাম, অমিত্রাক্ষর সব মাথা নেড়ে গোঁয়ারের মতো বলে গেছে না, না, না।
‘তুমি চলে যাও ‘ এই ছিলো তার শেষ কথা আর আমার শেষ সম্বল তার মুখ থেকে তুমি শোনা।
কার যেন এ মনের বেদন… তারপর যেন কী ছিলো… চোখে এই ভাদ্র দুপুরে এত জল কোথা আসে, কে জানে?
নুজহাত ইসলাম নৌশিন
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com