শব্দ . গল্প . কল্প
-আচ্ছা ওনার ঠিক একটাই সমস্যা? মানে কোনদিন এরকম তো হয় নি যে হঠাৎ খুব গেলেন, কাউকে যা ইচ্ছে বলে দিলেন।
-কয়েকবার টুকটাক ঘটনা হয়েছে, আমি সব বলছি।তাছাড়া উনি যথেষ্ট শান্ত প্রকৃতির মানুষ।এমনকি ওর অফিসের স্টাফেরাও খুব নাম করত।আমাকে বলত, ‘বৌদি আপনি প্রতীকদাকে কি খাওয়ান? কোন রাগ নেই। যা বলি হেসে উড়িয়ে দেয়।’
-কোন দিন কারোর উপরে রাগ দেখান নি।
–না, তবে কিছু ছেলে মানুষি করত। যেমন ধরুন ও একবার বিবাহবার্ষিকীর মিষ্টি কিনে টিফিন বক্সে ভরবার কিছু সময় পরেই একটা নামিয়ে দেয়।জিজ্ঞেস করাতে বলে, ‘প্রকাশকে দেবো না, ব্যাটা গল্প শোনে না, বলে কিনা আমি গল্প লিখতে পারি না।কিছু ক্ষণ পর অবশ্য আবার নিজের থেকেই মিষ্টিটা টিফিন বক্সে ভরে নেয়।’
-তার মানে লেখা গল্প কেউ না শুনলে ওনার একটু রাগ হত, সেটা সব সময় প্রকাশ করতেন না,তাই তো?
-ব্যাপারটা ঠিক সেটা নয়, ও এমনি তে খুব কম জনকেই নিজের লেখা শোনাত। বিশেষ করে বাপ্পা কাজ নিয়ে চলে যাওয়ার পর তো এক্কেবারে কাউকেই শোনাতে চাইত না।
–বাপ্পা মানে আপনার ছেলে ?
–হ্যাঁ।
-ওকে শোনাত?
–মাঝে মাঝে।তারপর একবার কলেজে সমস্যা হল, বাপ্পা রেগে গেল ?
–ঠিক কি রকমের সমস্যা হয়ে ছিল ?
-ভারি অদ্ভুত সমস্যা।একবার এক গার্ডিয়ান মিটিংএর সময় কোন এক স্টুডেন্টের মায়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কি সব বলে ওঠে, পরে শুনি তাকে নাকি বলেছে, ‘আপনাকে অনেকটা মামণির মত দেখতে।’
–মামণি কে?
-ওর কোন এক গল্পের একটা চরিত্র।একটা অবৈধ সম্পর্কের ওপর গল্পটা।সুপ্রতীক তারপর সবাইকে গল্পটা শোনায়।এটাতেই বাকি সবার কাছে বাপ্পা এমব্যারেস্ট হয়ে যায়, তার একমাসের মধ্যেই ঘর ছাড়ে হোস্টেলে থাকতে আরম্ভ করে, তারপর এখন আবার এক্কেবারে রাজ্য ছাড়া।
-আপনি আপনার ছেলেকে কোনদিন কিছু বলেন নি ?
-ওর শরীর খারাপের কথা বলেছিলাম। উত্তর দিল, ‘এখানকার ঘর বাড়ি বিক্রি করে ওর কাছে চলে যেতে।’
-বেশ, এবার একটা পুরানো কথা জিজ্ঞেস করব।উনি কি ছোট থেকেই লেখালেখি করেন ?
-না খুব ছোট থেকে নয়,ঐ কলেজ পড়বার সময়।তবে চাকরির চক্করে সব কিছু ভুলেও যায়। অফিসের মিত্রদা নামের একজন লেখালেখি করতেন।আগে অন্য জায়গায় ছিলেন পোস্টিং হয়ে প্রতীকের অফিসে আসেন, আর তাঁর সাথে আলাপের পরেই সুপ্রতীক আবার লিখতে শুরু করে।
–কি লিখতেন কবিতা না গল্প ?
– দুটোই।মাঝে মাঝে প্রবন্ধও লিখত।
-প্রবন্ধ!
-হ্যাঁ।আমাকে পড়ে শোনাত।
-তার মানে উনি পড়াশোনা করতেন।
-অফিস থেকে এসে বই নিয়েই বসে থাকত।এমনকি বাজার যেতে বললে বোঝা যেত বিরক্ত হচ্ছে।
–আবার কবে থেকে লিখতে আরম্ভ করলেন ?
-কবে থেকে হবে? বাবু তখন হায়ার সেকেন্ডারিতে পড়ে।তারপর বাবু কলেজের থার্ড সেমে চাকরি পেল, প্রতীক তারপরেই বলতে আরম্ভ করল, ‘অফিস থেকে রিটায়ার্ডমেন্ট নিয়ে শুধু লিখবে।’
-কিন্তু আপনি যে বললেন ওনার লেখা কোন বড় পত্রিকাতে প্রকাশিত হত না।
-বড় পত্রিকায় প্রকাশিত না হলেও লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হত।প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় যেতেন, বাড়িতেও অনেকে আসতেন, কিন্তু এই বাজারে যে সব ম্যাগাজিন চলে সেগুলোতে কোন লেখাই প্রকাশিত হয় নি।এমনি কি একই গল্প কখনো নিজের নামে কখনো বা আমার নামে পাঠাতেন।
–তাই! কেন?
-ওনার কোন বন্ধু ওনাকে বলেছিলেন, ‘বড় পত্রিকার হাউসে মহিলা রাইটারদের কদর বেশি থাকে।’ কিন্তু তাতেও প্রকাশিত হয় নি।
-বেশ।তার মানে ওনার সমস্যার সূত্রপাত ঐ রাতের বেলা বিছানা থেকে উঠে লিখতে বসা বা ব্যালকোনিতে বসে থাকার হাত ধরেই ?
-না, এর আগে উনি চুপচাপ বসে থাকলেই বিড় বিড় করে বকতেন।
–কি বলতেন ?
-প্রথম প্রথম শুনতাম না।পরে শুনলাম, ওনার নিজের গল্পের চরিত্রগুলোর সাথেই কথা বলতেন।মানে সব গল্প গুলোই তো আমাকে পড়াতো, সে থেকেই বুঝতাম।
–তখন কোন সাইক্রিয়াটিকের সাথে কনসাল্ট করেন নি ?
-করেছিলাম।প্রথমে ও বুঝতে পারেনি। পরে বুঝতে পেরে ডাক্তারবাবুকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করতে আরম্ভ করন।
–যেমন ?
-আমার মাথায় ঐ সব ঢুকত না, কিসব ফুকো, দেরিদা এই সব নিয়ে আলোচনা করত।
–বাড়িতেও ?
-মাঝে মাঝে একটা লাইন বলত, ‘মাটির সাথে মাটি মিশে যায়, কিন্তু ইটের সাথে ইট কখনো মেলে না।’
-আর?
-আর বলতে প্রায় আমাকে অভিনয় করতে হত।
–কিরকম?
-ওর মনে হত সবাই ওর সাথে দেখা করতে এসেছে, আমাকে চা তৈরী করে দিতে বলত।
–আপনি করে দিতেন?
-আমি কাপ ডিশে জল নিয়ে ওর কাছে নিয়ে যেতাম।ও ওর গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলত, চা খেতে বলত, কাউকে আবার টিফিন খাওয়ার জন্য বলত। আমাকে তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিত।না রেসপন্স করলে রেগে যেত।
–ওনার অফিসের কলিগদের সম্পর্কে আপনি কি জানেন একটি বলুন, মানে অফিসের মহিলা কলিগদের সাথে ওনার কি রকম সর্ম্পক বলতে পারবেন?
-দেখুন ও এমনি তে একটু চাপা স্বভাবের, আর অফিসের কোন মহিলা কলিগের সাথে কোন বিশেষ ধরনের সম্পর্ক থাকলে একটা তো ছায়া পড়বে, না সে সব কোন দিন কিছু বুঝতে পারিনি। কোন দিন পুরুষ কলিগদের সর্ম্পকেও সেরকম বিশেষ কিছু কোন দিন বলেনি।
-এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করি।আপনার সাথে ওনার সম্পর্ক কেমন ?
-স্বামী স্ত্রীর যেমন হয়।
–লাস্ট কোথায় ঘুরতে গেছিলেন ?
-লাস্ট বড় ট্যুর বলতেও সেটা বছর সাত আট আগে।সিকিম।তারপর প্রতি বছর অফিস ট্যুর হয়েছে, তবে কাছে পিঠে।
–আপনারা একই রুমে শোন তো ?
-হ্যাঁ।
-একই বিছানায় ?
-অবিয়াসলি।
-লাস্ট রেলেসিনশিপ ?
-আমাদের তো সেরকম কোন সমস্যা নেই।
–আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না।আমার একটি ডিটেলিং প্রয়োজন।আপানদের একটিই সন্তান ?
– হ্যাঁ।
-বিয়ের ঠিক কত বছর পর হয়।
–বছর দুই।
-সেকেন্ড ইস্যুর জন্য ট্রাই করেন নি ?
–না।
-কেন ?
-আসলে আমাদের দু’জনের ব্লাডগ্রুপ এক।শুনেছিলাম সেকেন্ড ইস্যু হলে পোলিও বা অন্য কোন রোগ হয়ে যেতে পারে তাই সাহস করিনি।
–আপনাদের ফিজিক্যাল রিলেসনশিপ কি তার পর থেকে রেগুলার, মানে টিল নাও ?
-( একটু চুপচাপ) নট নাও।
–কত দিন ধরে ধরে ইরেগুলার ?
-বছর তিন চার।
-ভেবে বলুন।
–পাঁচ বছর।
-এরপর ডাক্তার সেন আর কোন কথা না বলে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন।উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা চন্দনা এক ভাবে ডাক্তার সেনের দিকে তাকিয়ে থাকল।ঘরটাতে একটাই জানলা, জেব্রা পলিয়েস্টার ঝুলছে, চন্দনা নিজের সারা গায়ে ওরকম সাদা কালো দাগ দেখতে পেল।জানলার ওপাশে কি আছে? শহরের ভিতরে একটা মরূভুমির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেল।সুপ্রতীক হাঁটছে, হেঁটেই যাচ্ছে।
‘একাকিত্ব আর দুর্বলতা তূলনামূলক বেশি কল্পনার জন্ম দেয়, বলতে পারেন ভীতু মানুষও, যেটুকু শুনলাম তাতে মনে হল উনিও খুব ভীতু, লেখাটা তার কাছে একটা অবশেশন। এটা ভালো কিন্তু একটু সাবধানে রাখবেন, এই সব মানুষের একটু সুইসাইডের টেনসেন্সি আছে।’
চেম্বার থেকে বাইরে বেরিয়েও ডাক্তারবাবুর বলা শেষ কথাগুলো মাথার মধ্যে হিজিবিজি কাটছিল।সুপ্রতীক কি সত্যিই ভীতু? বিয়ের পর কোন দিনই কোন রকম অ্যাগ্রেসন দেখায় নি এটা ঠিক কিন্তু বাপ্পাও তো জন্মেছে।ও জন্মানোর পরও?না কোন কিছুই নিয়মিত হয় নি। তাদের জীবন অফিস, বাপ্পার স্কুল, কয়েকজন আত্মীয়ের মধ্যেই চড়কি খেতে আরম্ভ করে।রাতে দুজনের এক বিছানার মধ্যে কোন গ্যাপ না থাকলেও বাপ্পা ছিল।
বাসের জানলার পিছনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সবকিছুর সাথে নিজেকে এক করবার সময় সুপ্রতীকের লেখা পাণ্ডুলিপির পাতাগুলোও উড়তে লাগল। পিছনে ছুটছে সুপ্রতীক, একটা বাসের স্টপেজের ওয়েটিং রুমে বাপ্পা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল।চন্দনার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করল, ‘তোর বাবা ছুটছে, তোর বাবা ছুটছে।’ হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগল।‘এই রে বাপ্পা যদি ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করে? মানুষটাও বা এতক্ষণ ধরে কি করছে কে জানে?’
কোথাও বাইরে গেলে আজকাল চন্দনা পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চা ছেলেটাকে সুপ্রতীকের কাছে বসিয়ে দিয়ে আসে।বড়ছেলেরা কেউ ওর কাছে বসে না, বলে ‘জেঠু খুব বকে, কিচ্ছু বুঝিনা।’ সুপ্রতীক আবার এই বাচ্চাটকে খুব পছন্দ করে।নামটিও বেশ, বুমকা, প্রায় ওর জন্য চকলেটও নিয়ে আসে।
চন্দনা তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলতেই ভিতরের অন্ধকারটা কেমন যেন টালমাটাল করে দিল।ঘরটা এক্কেবারে শূন্য।কোন মানুষ যে এখানে থাকতে পারে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।চন্দনা একবার বুমকার নাম ধরে ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে ঘরের আলো জ্বেলে ভিতরের ঘরে গিয়ে চমকে উঠল।তাহলে কি ডাক্তারবাবু যা বললেন সেটাই সত্যি হতে যাচ্ছে?হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করল। কিছু সময় পর বারান্দার আলোতেই দেখতে পেল ঘরের ভিতরে এক্কেবারে মাঝে সুপ্রতীক বসে আছে আর তার চারদিকে এক গাদা কাগজ পড়ে আছে।একটু শান্তি পেল চন্দনা, সুপ্রতীককের নাম ধরে ডাকতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলে উঠল,‘ও তুমি এসে গেছ, আমি কিছু ক্ষণ আগে চা করতে বললাম।বিপাশা অনেকক্ষণ ধরে এসে বসে আছে।ওর মায়ের কি একটা অপারেশন হবে।কিছু টাকার দরকার, তাই ব্যাঙ্কের বইগুলো দেখছিলাম।তুমি কি আমাকে একটু হেল্প করতে পারো ?’
চন্দনা কোন কথা না বলে আস্তে আস্তে সুপ্রতীকের পাশে বসে ওর মাথাটা টেনে নিজের বুকের মাঝে আটকে রাখতেই দুচোখ দিয়ে টপ টপ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।বুঝতে পারল না ঠিক কি করা যেতে পারে। দু’হাতে মুখটা চেপে রেখে কিছু সময় বসে থাকতেই বাইরের দরজায় টোকা মারবার আওয়াজ পেল।দ্বিতীয় বার আওয়াজটা শুনে দরজাটা খুলতেই দেখল বাইরে বুমকার মা।চন্দনাকে দেখে এক গাল হেসে বলে উঠল, ‘বৌদি, দাদাকে কি খাওয়াচ্ছো গো, সেই দুপুর থেকে দেখো গে বাচ্চাদের সাথে খেলে যাচ্ছে।’
-খেলে যাচ্ছে? কাদের সাথে?
-কেন বুমকাদের সাথে,ঐ তো কমপ্লেক্সের পিছনের মাঠটাতে।তুমি তোমাদের ঐ’দিকের ব্যাকলোনিতে যাও দেখতে পাবে।চন্দনা আর কিছু না বলে হাসি মুখেই দরজাটা লাগিয়ে মুখ ফেরাতেই দেখল সোফাতে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন।একটু অবাক হল চন্দনা, একি একই শাড়ি পরে আছে, অদ্ভুত তো। চন্দনার দিকে একভাবে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে দেখে রাগে গা পিত্তি জ্বলতে আরম্ভ করল।চিৎকার করে বলল, ‘হাসছেন কেন? হাসার কি আছে, আর কে আপনি?’
-সেটা নিজেকেই জিজ্ঞেস কর, অথবা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও।
চন্দনা তাড়াতাড়ি বারান্দার আয়নার সামনে দাঁড়াতেই পিছনে একটা মিছিল দেখতে পেল সবার হাতে একটা করে প্ল্যাকার্ড।কারোর প্ল্যাকার্ডে লেখা অদিতি, কারোরটাতে সুমনা, কারোর বা জেসমিন।সোফার ভদ্রমহিলা এতক্ষণে চন্দনার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।তার হাতেও একটা প্ল্যাকার্ড, তাতে জ্বল জ্বল করছে চন্দনার নিজের নামটা।
সমাপ্ত
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com