শব্দ . গল্প . কল্প
(এই গল্পটি সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে আর আমার কল্পনায় )
শীত প্রায় চলে যাবে যাবে ভাবছে এই সময় বসন্ত এসে গেল একঝাঁক আনন্দ নিয়ে। খুব ভালো লাগছে এখন, শীতের দাপট আর যেন ভালো লাগছিল না। Massachusetts এর একটি শহর Shrewsbury যেখানে আমরা থাকি। মে মাসের প্রথম দিকে বাড়ির বাইরে যেদিকেই তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ, আর উপুরি পাওনা বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন ফুলের সমারোহ। মনটা খুশিতে ভরে ওঠে।
2020 যে ভাবে শুরু হয়েছিল খুব খারাপ কিন্তু ছিল না, কিন্তু ফেব্রুয়ারী র শেষ থেকে হঠাৎ করে আমাদের সকলের জীবন যেন রাতারাতি পাল্টে গেল। একটা আতঙ্ক এসে বাসা বাঁধলো সকলের মনে। ভালো কিছু ভাবতে চাইলেও ভাবতে পারছিনা, সকাল থেকে রাত্রি ফোন এ যার সাথেই কথা বলি আর টিভি দেখি একই কথা “কোভিড 19 “। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় কি যে হবে, কবে যে আবার স্বাভাবিক হবে কিছুই তো জানিনা। শুরু তো জেনেছি কিন্তু শেষ জানা নেই।
এরই মধ্যে একদিন সকালবেলা 11 টা নাগাদ আমাদের সামনের deck এ বসে চা খেতে খেতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি, শুনশান রাস্তা, গাড়ি প্রায় দেখাই যায়না। হটাৎ দেখি দুটো হরিণ রাস্তা দিয়ে দিব্যি গদাই চালে হাঁটছে, যতদূর দেখা যায় ওদের দিকেই তাকিয়ে থাকলাম। গরমের সময় হরিণ সবসময়ই দেখা যায়, এটা নুতন কিছু নয়। কিন্তু সেদিন হরিণ দুটির পথচলা দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, ওরা নিশ্চয়ই বলাবলি করছে আর হাসছে, “দেখ দেখ সমাজের সভ্য লোকগুলোর কি অবস্থা, কোরোনার ভয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে আছে, বেশ হয়েছে বল? কি দেমাক এক এক জনের, আর আমরা পশু বলে কত হেনস্থাই আমাদের হতে হয়। এবার বোঝো কত ধানে কত চাল।“ তখন আর একটি হরিণ উত্তরে বলছে, “সত্যি বলেছিস রে একটু রাস্তা পেরিয়ে এই জঙ্গল থেকে উল্টো দিকের জঙ্গল এ যে যাবো তার কোনো উপায় নেই। গাড়ি গুলোর জন্য, কতবার যে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছি সে আর কি বলবো।“
হরিণদের এই কথোপকথন ভাবতে ভাবতে একটা সত্যি ঘটনা মনে পড়ে গেলো।
সাল 2019, আমাদের এক বন্ধু পিকা, এখানকার এক কলেজের প্রফেসর। পিকার একটা কনফারেন্স ছিল কানাডার ( টরেন্টো ) তে মে, মাসের মাঝামাঝি। ও নিজে ড্রাইভ করেই গিয়েছিলো, আবার ফেরাটাও ড্রাইভ করেই ফিরছিলো। এতো দীর্ঘ পথ প্রায় সাড়ে আট ঘন্টা, তাই ফেরার সময় খুব ভোরের দিকেই বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছিলো যাতে সন্ধ্যের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছাতে পারে।
মোটামোটি বিকেল তিনটের মধ্যে Albany পেরিয়ে গিয়েছে, পিকার তো আনন্দ আর ধরেনা। আরো বেশ কিছু পরে Massachusetts এ ঢুকে যাবে। গাড়ির মধ্যে music চালিয়ে দিব্যি আসছে আর ওর কনফারেন্স এর একথা সেকথা কথা ভাবছে। বাড়ীতে গিয়ে খুব ভালো করে স্নান করে যাহোক কিছু খেয়েই শুয়ে পড়বে, কারণ পরেরদিন সকাল নটা থেকে ক্লাস নিতে হবে। ঠিক এই সময় ঘটলো একটা বড়োসড়ো বিপত্তি, একটা বড় হরিণ রাস্তা পেরোতে গিয়ে পড়লো তো পর ওর গাড়ির সামনে। ও গাড়ির ব্রেক দিলেও হরিণটিকে জখম এর হাত থেকে বাঁচাতে পারলোনা, দুটো পায়েই বেচারার বেশ লেগেছিলো এবং ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছিলো। এদিকে পিকা র তো প্রচন্ড ভয় ও অপরাধ বোধ হচ্ছে, গাড়ির সামনেটা ভেঙে চুরমার। এবার তো ওকে স্টেট পুলিশ ডাকতেই হবে, আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী। পিকা 911 কল করে বসে আছে গাড়ির মধ্যে, আর হরিণ বেচারা রাস্তার ধারে বসে আছে, ওর পা দিয়ে রক্ত পরেই যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে পুলিশ এলো, পিকার কাছ থেকে ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে পুলিশ আবার নিজের গাড়িতে গিয়ে বসে সব চেক করে গাড়ির থেকে যখন নামছে ততক্ষনে হরিণটি লেঙরে লেঙরে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। State trooper পিকা কে অপেক্ষা করতে বলে জঙ্গলের মধ্যে ঢুঁকে গেলো, আর তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনটে গুলির আওয়াজ হলো। তার পরে পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এসে পিকার কাছে জানতে চাইলো “do you want a portion of deer meat“?
পিকা তো হতভম্ব, কি বলছে ? সাথে সাথে বললো না না আমার চাইনা। একথা শোনার পরে আবার জঙ্গলের ভিতরে চলে গেল পুলিশ অফিসার, তারপর মৃত হরিনটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে গাড়ির trunk এ ঢোকালো। accident এর একটা রিপোর্ট লিখে নিলো। ইতিমিধ্যে পিকাও car insurance এর সাথে কথা বলে, গাড়ি tow করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো, ভারাক্রান্ত মন ও ভাঙা গাড়ি কে সাথে নিয়ে।
পিকার কাছ থেকে এই ঘটনাটা শোনার আমার মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো আর মনে হচ্ছিলো অনেক সময় হয়তো হটাৎ করে কোনো পশু গাড়ির সামনে এসে পড়লে আমরা শত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনা। এই হরিণটা কিন্তু জখম হয়েও বেঁচে ছিল। হয়তো বাঁচার জন্যই জঙ্গলের ভেতরে চলে গিয়েছিলো।
2020 সারা পৃথিবী জুড়ে হয়তো ক্রমাগত বিপর্যয়ের সংকেত নিয়ে আসছে আমাদের সকলের জন্য, কিন্তু প্রকৃতির কাছে ও পশু পক্ষীদের জন্য এ এক বিরল আনন্দের সময়। সবকিছুর যেমন শুরু আছে, তার শেষ ও তো আছে তাই আশা রাখি। এই দুর্বিপাক শেষ হলে, যে পৃথিবীকে আমরা পাবো, সেটা যেন পারস্পরিক সমন্বয় ও ভালোবাসায় ভরা থাকে। যে বিপর্যয় আমরা আবালবৃদ্ধ বনিতা সকলে দেখলাম সেটা যেন আর কখনো দেখতে না হয়।
তোমারি সৃষ্টি সকলি আমরা
জননী বসুন্ধরা
মিলে মিশে যেন থাকতে পারি
যুগে যুগে আমরা।
কৃষ্ণা দেব
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com