শব্দ . গল্প . কল্প
বিকেলবেলায় নতুন রহস্যগল্পটা নিয়ে বসেছি, মা অফিস থেকে ফিরে ধমক দিয়ে বললেন, “সবসময় কি বই মুখে করে থাকিস বল তো। বড্ড একা একা স্বভাব তোর । যা নিচে পার্কটায় ঘুরে আয় একটু ।” গোমড়া মুখে নিচে নামার জন্য তৈরি হলাম । আমাদের আবাসনটা কুড়িতলা, আমরা থাকি দশতলায় । এর আগে আমরা থাকতাম আসানসোলের কাছে একটা জায়গায়, বেশ একটা গ্রাম গ্রাম ভাব ছিল । কাছেই ধানখেত, আমবাগান, ঝিরিঝিরি একটা নদী । আমার ঠাকুর্দার আমলের বাড়ি ওখানে। ঠাম্মা জ্যেঠুমণিরা সব রয়ে গেছেন ওখানেই। বাবা সরকারি চাকরি করেন, একটা বড়ো প্রমোশন পেয়ে চলে এসেছেন এখানে কিছুদিন আগে । চমৎকার বড়ো বারান্দাওয়ালা ফ্ল্যাট, সবার খুব ভালো লেগেছে, তাছাড়া কলকাতা শহরে থাকার কতো সুবিধে, তাই না।
আমার মন লাগে নি কিন্তু । ছোট থেকেই আমি একটু চুপচাপ, লাজুক আর মুখচোরা । বল্লভবাটিতে আমার জন্ম, ওখানে কতো চেনাশুনো, বন্ধু বান্ধব । এখানে একটা নামী স্কুলে ভর্তি হয়েছি । বন্ধু টন্ধু একটু আধটু হয়েছে বটে, কিন্তু বেশী না । একা হয়ে গেছি বেশ – বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন, “মানিয়ে নিতে তো একটু সময় লাগবে, মা । পরে কতো বন্ধু হয়ে যাবে দেখিস । আর তোর গানের স্কুলটাও খুব ভালো জানিস তো ।”
যাক গে। নিচে একটা বড়ো পার্ক বাগান মতো আছে আবাসনটার সঙ্গে । সবুজ গাছপালা, ঝলমলে ফুলটুল, একটা সুইমিং পুল, হাঁটার বসার খেলাধুলোর আলাদা জায়গা । এই আবাসনে ঠিক আমার বয়সী নেই কেউ । বারো তেরো বছর বয়সে অপরিচিত দুতিন বছরের ছোটোবড়োদেরও বয়সের পার্থক্যটা বেশী মনে হয় । তাছাড়া আমি অতো এগিয়ে গিয়ে ভাবটাবও করতে পারি না । আমি একটু এদিক ওদিক ঘুরলাম, একটা দোলনায় বসে নতুন শেখা গানটা গুনগুন করলাম একটু । একধারে কলাবতী ফুলের ঝোপগুলোর কাছে, একটা বেঞ্চি থেকে সামনের রেলিংঘেরা ছোট্ট বাচ্চাদের খেলাধুলো করার জায়গাটা দেখা যায় । ওখানে বসে আমি দেখি রঙীন বাচ্চারা বল নিয়ে ছোটাছুটি করছে, দোলনায়, মেরি-গো-রাউণ্ডে উঠছে, কিচিরমিচির করছে, আয়ামাসিরা গল্প করছে নিজেদের মধ্যে । আর আকাশপাতাল ভাবি । মন্দ লাগে না । তবে মনটা খারাপ খারাপ লাগে মাঝে মাঝে ।
আজ সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখি, ওমা, আমার বয়সী একটা মেয়ে আগে থেকেই বেঞ্চিটায় বসে আছে । খুব খাটো করে চুল কাটা, ফরসা রঙ, জোড়া ভুরুর নিচে খুব উজ্জ্বল দুটি চোখ । আমি থেমে গিয়েছিলাম, সে আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলো, সরে গিয়ে সহৃদয়ভাবে বললো, “এসো, বসো না।” যেন কতদিনের চেনা । ওর গলাটা খুব মিষ্টি, রিনরিনে, একটু যেন উঁচু তারে বাঁধা । আমি আস্তে আস্তে গিয়ে বসলাম ওর পাশে । বললাম, “তুমি এই বিল্ডিংএই থাকো বুঝি ?”
“হ্যাঁ…” একটু থেমে, “এখানেই থাকি । এখন ।”
“আগে দেখি নি তোমায়, আমরাও অবশ্য বেশি দিন আসি নি ।”
“আমি তো আসি এখানে মাঝে মাঝে – এই তো তুমি দেখতে পেলে আমায় আজ ।”
“আমার নাম রাকা । আর তোমার ?”
“অলোকা ।”
খুশি হয়ে বললাম, “অলকা – তাই নাকি, জানো ওই নামে আমার ছোটবেলার একজন বন্ধু আছে, সে…।”
“অলকা নয় । আমার নাম অলোকা । “থেমে থেমে বললো, “অ-লোকা ।”
“কোন তলায় থাকো গো তোমরা ? আমরা দশতলায় ।”
“তেরোতলায়।”
ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম । তেরোতলা বলে তো কিছু নেই । বাবা বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে, তেরো সংখ্যাটা অশুভ মনে করা হয় বলে – যদিও এটা কুসংস্কার – এরকম উঁচু বাড়িতে অনেক সময় তেরোতলা বলে কিছু রাখা হয় না , বারোর পরে সোজা চৌদ্দ, যেমন এ বাড়িটায়, কিংবা ১৪এ আর ১৪বি-ও করে কোথাও কোথাও । আমি ভেবেটেবে বলেছিলাম, “কিন্তু তা-ও, আসলে তো তাহলে চৌদ্দতলাটা বা চৌদ্দএ তো তেরোতলাই হলো তাই না ?” মা হেসে বলেছিলেন, “যুক্তি তো তাই বলবে – কিন্তু কুসংস্কার কি যুক্তি মানে ! তেরো সংখ্যাটা তো এড়ানো গেলো তাই না !”
এখন অলোকাকে বললাম, “তেরোতলা নেই তো ! তুমি চৌদ্দতলার কথা বলছো বুঝি ?”
“না , তেরোতলাই । আছে তো । নইলে আছি কি করে ।” একটু হাসলো ।
কেমন ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম । তার পর ভাবলাম, যাক গে, চৌদ্দতলাটাকেই মজা করে তেরোতলা বলছে হয় তো ।
“রাকা, তুমি যেখানে থাকতে সেখানকার কথা বলো আমায় ।”
এতোদিন প্রায়ই কেউই এমন করে শুনতে চায়নি আমার ফেলে আসা জন্মস্হানটির কথা, যেখানকার কথা ভাবলেই আমার মনটা ছলছল করে । আমি মহা উৎসাহে বলতে লাগলাম বল্লভবাটিতে আমাদের বাড়ি, আমার ঠাম্মা জ্যেঠিমা পিসিমা আর ভাইবোনদের কথা, আজন্মসঙ্গী বন্ধুরা, স্কুলের কথা, জিরুনি নদী আর পোষা কুকুর চেরি… আর সারাক্ষণ অলোকা ওর ঝকঝকে চোখদুটি আমার চোখে ফেলে রাখলো, যেন আমার চোখের মধ্যে ও সবকিছু দেখে নিচ্ছে, জেনে নিচ্ছে…।
“…আর দুপুরবেলা ধানখেতে কেমন ঢেউ খেলিয়ে হাওয়া দেয়, রাত্রে দূউউর থেকে ট্রেনের হুইসল শোনা যায়, বড় রাস্তায় ট্রাক আর গাড়ির আওয়াজ আর সাইকেলের ঘন্টি থেমে গিয়ে সব চুপচাপ, আর জোনাকিরা জ্বলে নেভে…”
থেমে গেলাম । এতো কথা কাউকে বলার সুযোগ পাই নি আগে । দেখি কতোটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে, বিকেল শেষ, বাচ্চারা প্রায় সকলেই ফিরে গেছে । আর আমি নিজের কথা বলেই যাচ্ছি ।একটু অপ্রতিভভাবে বললাম,
“এবার তোমার কথা বলো, তুমি কোন স্কুলে পড়ো, অলোকা ? কোন ক্লাসে ?”
সে কথার উত্তর না দিয়ে ও বললো, “খুব মন কেমন করে, না, তোমার ? ওই জায়গাটার জন্যে ।”
“হ্যাঁ, করে তো, মনে হয় আবার ফিরে যাই ।”
অলোকা দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লো । “নাঃ, ওখানে আর থাকা হবে না তোমার । তবে স্বপ্ন দেখতে চাও ওখানকার, খুব সুন্দর স্বপ্ন ?”
আমি ওর দিকে চেয়ে রইলাম । ও খুব আলতো করে আমার ভুরুর মাঝখানটা ছুঁয়ে দিলো, কি ঠাণ্ডা স্পর্শ… আমার মাথাটা একটু দুলে গেলো যেন । বললো, “আজ রাত্রেই দেখবে ।”
কি রকম একটা লাগছিলো, কিন্তু ওকে খুব পছন্দ হচ্ছিলো আমার । বললাম, “আমাকে যেতে হবে এবার…তুমি কাল আবার আসবে তো ।”
“আচ্ছা, আসবো । শোনো রাকা, আমার কথা কাউকে বলো না কিন্তু ।”
“কেন গো ?”
“তাহলে আমাকে আর আসতে দেবে না ।”
“কারা? তোমার বাড়ির লোকেরা ?”
এবারেও উত্তর দিলো না ।আমি বললাম, “চলো আমরা ফিরে যাই ।” ও বললো, “তুমি যাও, আমি এখন যাবো না ।” আমি বললাম, “অন্ধকার হয়ে আসছে যে ।”
“তাতে কিছু হবে না ।”
মুখ-আঁধারি অন্ধকারে ওর মুখটা অস্পষ্ট হয়ে এসেছিলো । আমি লবির গেটের দিকে পা চালালাম । লিফটে উঠতে গিয়ে ভালো করে দেখলাম, তেরোতলা লেখা কোনো বোতাম নেই । ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে দেখি, কে প্রতিবেশীরা এসেছেন, মা বাবারা কথা বলছেন, কাজের মাসি মোহনাদিদি রান্নাঘরে ব্যস্ত । তেরোতলার কথাটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না । হোমওয়ার্ক নিয়ে বসার আগে আমার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, সেই বেঞ্চটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তাতে কেউ বসে নেই । অলোকা ওপরে চলে গেছে নিশ্চয়ই । মেয়েটা একটু কেমন যেন কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং, রাতে বিছানায় শুতে শুতে ভাবলাম ।
রাতে কিন্তু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম ।
দেখলাম যেন আমি বল্লভবাটিতেই ঘুরে বেড়াচ্ছি । কিন্তু কেমন যেন অন্যরকম । চমৎকার একটা আলো, সকালেও নয়, দুপুরও নয় বিকেলও নয় কিন্তু সব আছে । কখনো দেখি শরতের পূজোপূজো ভোরে শিউলি কুড়োচ্ছি, কখনো দুপুরের ধানখেতের আল ধরে ছুটছি । কত্তো লোক চারধারে । আমার সব বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজনেরা । সবাই খুব হাসছে । যেন উৎসব হচ্ছে, সব্বাই খুব সেজেছে । আমার বড়ো পিসঠাকুমা, যিনি গত বছর মারা গেছেন, তিনি আমাকে হাসিমুখে নারকোল নাড়ু দিলেন, আর দুবছর আগে রামু দুধওলা ট্রাকের ধাক্কায় মারা গিয়েছিলো, সে সাইকেলে করে ক্যান নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে । তিতলি, রূপা, জীয়ন, মিলুদের সঙ্গে খুব ছুটোছুটি করছি, আর সবসময় অলোকা আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে, সেটাকে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে । খুব রঙ খেলছি আমরা, আবিরে লাল সবাই, রূপাকে একদম চেনা যাচ্ছে না, হি হি, কিন্তু অলোকার সাদা ড্রেসটাতে একটুও রঙ লাগছে না । ওমা, কালবোশেখী এলো তো, রণেনকাকুদের আমবাগানে আমরা আম কুড়োচ্ছি, কাঁচা পাকা আম সঅব একসঙ্গে, কি মজা… অলোকা আমার হাত ধরে বললো, চলো যাই । আমি বললাম, তুমি যাও আমি একটু পরে যাবো, আর অলোকা খুব হাসছে, কি মিষ্টি রিনরিনে হাসি, হাসতে হাসতে বলছে, “দূর রাকা, তেরোতলা থেকে কি একা একা নামা যায় নাকি…তেরোতলা, তেরোতলা…।”
(ক্রমশ)
তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতির জন্য এখানে ক্লিক করুন
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com
This website has been developed on WordPress by Red Panda Digital Creations.