গল্প একটাই

‘গার্গী সান্যাল দেখতে ছোটখাটো, ফর্সা। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে গৃহবধূ। নেহাত খুব জোরাজোরি করলে কেউ বলবে ইস্কুল টীচার। নানা হাইস্কুল কোত্থেকে হবে ওই চেহারায়। উনি তো ক্লাসই ম্যানেজ করতে পারবেন না। অতএব প্রাইমারী ইস্কুলের টিচার হলেও হতে পারেন।  

আমাদের এই গার্গী হাইকোর্টের জাঁদরেল বিচারক।

ওনার বয়েস বেশি নয়। বছর পঁয়তিরিশের মধ্যেই উকিল থেকে জাজ হয়ে গেছেন। লোকে বলে গার্গীর বাবা কেতন মৈত্র’র ওকালতি ডি এন এ তার একমাত্র এই মেয়ের ওপর পুরোমাত্রায় ছাপ রেখে গেছেন। মেজ, সেজো তো বটেই বড় উকিলবাবু’রাও জানেন ওনার এজলাসে ট্যাঁফোঁ করার উপায় নেই। ‘মি লর্ড’ যা বলবেন সেটাই মামলার শেষ কথা। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হেরে গিয়ে বিচারপ্রার্থী সুপ্রীম কোর্টে গেলেও দেখা গেছে রায়ের বিশেষ হেরফের হয় নি।

এই গার্গী সান্যালের এজলাসে একদিন একটা কেস উঠল। লোয়ার কোর্টের রায়ে স্ত্রী’কে খুনের অভিযোগে বছর বত-তিরিশের রুদ্রনীল বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ রুদ্রনীলের বিপক্ষে। তা সত্বেও রুদ্রনীলের পরিবার যখন হাইকোর্টে আপীলের সিদ্ধান্ত নিল তখন সরকার পক্ষ অবাকই হয়েছিল। পাবলিক প্রসিকিউটার রুদ্রনীলের উকিল’কে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘লাভ নেই। রুদ্রনীলের বিপক্ষে যা সাক্ষ্য প্রমান আছে তাতে স্বয়ং ধর্মরাজ এলেও ওকে বাঁচাতে পারবে না’। রুদ্রনীল মানে নি। অতএব..

এ হেন আমাদের গার্গীর ব্যক্তিগত জীবন একেবারে বিষময়। কেতনবাবু দেখেশুনে তাঁর পরম মিত্র ডাক্তার বিশ্বজিৎ সান্যালের একমাত্র ছেলে, যুধাজিতের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে গেছিলেন। কিন্তু খোঁজ করে দেখেননি যুধাজিত বাবার সম্পত্তি পাওয়ার আগেই সেটা বহুলাংশে রেসের মাঠে খুইয়ে রেখে এসেছিল। দেনার চাপে জর্জরিত যুধাজিতের একমাত্র অপেক্ষা ছিল বাবার চোখ বোজার। এর মধ্যে কৃতী উকিল এবং পয়সাওয়ালা হবু শ্বশুরমশায়ের একমাত্র মেয়ের সম্বন্ধ আসতেই যুধাজিত বুঝে গেছিল রেসের মাঠের বাইরে এটাই ওর জীবনের জ্যাকপট। বিশ্বজিৎবাবু চোখ বুজতে না বুজতেই যুধাজিত গার্গীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলল। শেষে যুধাজিত গার্গি’র গায়ে হাত দেওয়ায় এমন অবস্থা হল কেতন পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন গার্গী’কে চলে আসতে, তাতে যা হবার হবে। কিন্তু পাঁচ বছরের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে গার্গী বাপের বাড়ি ফিরে আর যেতে পারল না। ছেলেটা বড্ড বাপের ন্যাওটা যে!

আদালতে সওয়াল জবাব শুনতে শুনতে গার্গী এইসব সাত পাঁচ ভাবছিলেন। সম্বিত ফিরল রুদ্রনীলের উকিলবাবু’র পরবর্তী শুনানির তারিখ একটু পেছিয়ে দেবার অনুরোধ শুনে। গার্গী সাধারণত দেখেছেন আসামী পক্ষ শুনানীর তারিখ এগিয়ে আনতে চায়; তাই মুখ তুলে রুদ্রনীলের দিকে একবার ভালভাবে তাকিয়ে নিলেন। কালো, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মাঝারি লম্বা, টানটান চেহারার, সপ্রতিভ রুদ্রনীলের সাঙ্ঘাতিক ব্যক্তিত্ব না থাকলেও গার্গী খেয়াল করে দেখেছেন কি যেন একটা আছে। শুনেছেন উনি মফস্বলের ইস্কুল মাস্টার। এমনকি পাবলিক প্রসিকিউটারের বিধ্বংসী জেরার মুখেও রুদ্রনীল’কে কখনো ঘাবড়াতে দেখেননি গার্গী। উলটে পিপি’র সঙ্গে হাল্কা হাসি ঠাট্টার মোড়কে তাকে ব্যাপক বেইজ্জিত করাতে সময়ে সময়ে গার্গী’কে কোর্টে হাসির হল্লা টেবিলে গ্যাভেল পিটিয়ে অর্ডারে আনতে হয়েছে, সাবধান করতে হয়েছে অভিযুক্ত’কে। গার্গী মাঝে মাঝে ভেবেছেন এটাকেই কি এক্স ফ্যাক্টর বলে? তিনি উকিলবাবুকে প্রশ্ন করেন তারিখ পেছতে চাওয়ার কারন। উকিলবাবু সবিনয়ে জানান মুর্শিদাবাদ থেকে আসামী’র মা বাবা অভিযুক্ত’র একমাত্র সন্তান কে নিয়ে কোলকাতায় আসছেন। আসামী ওই সময়টা নিজেকে মামলা থেকে খানিকটা দূরে রাখতে চান। গার্গী ভাবেন অদ্ভুত লোক তো। নাকি ফাঁসী এড়াতে পারবেন না জেনে সময় ব্যয় করতে চান আদালতের। কিন্তু অভিযুক্ত’কে দেখে কখনো তার মনে হয় নি ফাঁসীর ভয়ে উনি জুজু হয়ে আছেন। সেটাও গার্গীর কাছে এক অদ্ভুত বিস্ময়। আর এই ধরনের মামলায় বিরোধী পক্ষ সন্তান নিমেষে নিজেদের পক্ষে করে নেন। এখানে সেটাও উলটো। সন্তান এখনো অভিযুক্তের সঙ্গেই। ‘দেখা যাক’। গার্গী পরবর্তী শুনানি’র দিন ধার্য্য করে দিয়ে উঠে যান এজলাস লাগোয়া নিজের চেম্বারে।

দু মাস পরে আবার রুদ্রনীলের কেসের ডেটের দিন গার্গী রোজকার সাদামাটা তাঁতের শাড়ি না পরে ওর খুব পছন্দের একটা জঙ্গল সবুজ জমীন আর মেঘ রঙের টেম্পল পাড় দেওয়া ইক্কত পরে কোর্টে গেলেন। যদিও বিচারকের গাউন গায়ে চড়িয়ে নেবার পর শাড়ি’র একটা ভগ্নাংশ বই দেখা যাবে না। তবুও। আজ রুদ্রনীল পরে এসেছেন একটা সন্ধ্যে সবুজ রঙের জীনস আর টিয়াপাখি সবুজ, কলার দেওয়া টী-শার্ট। এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন কনস্টেবল আর এক জন পুলিশ অফিসারের মাঝে মনে হচ্ছে আদালত কি বস্তু তিনি আগে কোনদিন দেখেননি আর আজ তাই চাপা কৌতূহলে সেই গুঞ্জন দেখছেন। সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে গার্গী মন দেন এজলাসের কাজে। শুনানি শুরু হতে ওনার চোখ পরে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো রুদ্রনীলের পেছনে, ওর বাবা মায়ের কোলে বসা একজন মেন্টালি চ্যালেঞ্জড বাচ্চার দিকে। মেয়ে। বছর চারেক বয়েস হবে। ‘আচ্ছা? তাই কি ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাচ্চাটার কোন দায়িত্ব কেউ নিতে চান নি?’ অভিযুক্তের বাবা মা’কে গার্গী আগেও দেখেছেন। বাচ্চটিকে এই প্রথম। গার্গী সেদিন পৃথিবীর সমস্ত মনযোগ এক করে শুনানি’টা শুনলেন। নাহ, সব সাক্ষ্য প্রমান যেন রুদ্রনীলের বিপক্ষে হাঁ করে চেয়ে আছে পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে ঝলমলে বিজ্ঞাপনের মত। গার্গীর এত দিনের ওকালতি করা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও বলছে রুদ্রনীল তার স্ত্রীকে আলবাত খুন করেছেন।

কিন্তু মনের মধ্যে কোন এক আধো অন্ধকারে গার্গী রুদ্রনীল’কে এত তাড়াতাড়ি ফাঁসির দড়ি থেকে ঝুলতে দেখতে চান না। গার্গী আপ্রাণ চেষ্টা করেন এই আলোড়ন থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু যত মামলা এগোয় গার্গীর অন্তরাত্মা সেই যুদ্ধে ক্রমাগত হেরে যেতে যেতে এবার ওকে এনে দাঁড় করায় এক অদ্ভুত, অন্তিম পরিক্ষার সামনে। 

এই প্রথম গার্গীর মন না চাইলেও ওর ভেতরের কোন এক অদম্য, উদ্বেলিত কণ্ঠস্বর ওকে ক্রমাগত বলে এই রুদ্রনীল’কে এক কাকভোরে পায়ের নীচে তক্তা সরে যাওয়া থেকে বাঁচানোর পথ আছে। আলবাত আছে।

তাই গার্গীর শেষ বিচারে রুদ্রনীল বিশ্বাসের ফাঁসির হুকুম রদ হয়ে যাওয়ার রায় যার কোন কিছুতেই কিছু এসে যায় না তাকেও চমকে দিল। আলোড়িত হল তামাম দুনিয়া।

রুদ্রনীলের শ্বশুরবাড়ি মামলা সুপ্রীম কোর্টে নিয়ে গেল।

গার্গী আবার সবাইকে অবাকের থেকেও বেশি করে বিচারকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঘোষণা করলেন রুদ্রনীলের সুপ্রীম কোর্টের মামলা তিনি লড়বেন।

চার বছর সুপ্রীম কোর্টে মামলা চলাকালীন গার্গী’র ব্যস্ততা উঠল চরমে। একদিকে রুদ্রনীলের মামলায় ঘনঘন দিল্লী যাতায়াত অন্যদিকে যুধাজিতের সঙ্গ ত্যাগ করে বাপের বাড়ি ফিরে এসে নিজের ডিভোর্সের মামলা চালানো। তার সঙ্গে যোগ হল রুদ্রনীলের বৃদ্ধ বাবা মায়ের এবং রুদ্রনীলের মেন্টালি চ্যালেঞ্জড বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া, তার যথা সম্ভব চিকিৎসা আর কেয়ার করার। গার্গী’র প্রায় দশ বছরের ছেলে কিন্তু বলল ও বাবা’র কাছেই থেকে যাবে। গার্গী এই প্রথম কোন বড় মামলার আগেই সেটা আদালতের বাইরে হেরে গেলেন।

দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর নিমেষে মুছে যেতে লাগল গার্গীর জীবন থেকে।

অবশেষে বহুবার গীতায় হাত রাখা রুদ্রনীলকে গার্গী শুধু ফাঁসির হুকুম রদ নয়, একদম বেকসুর খালাস করিয়ে নিয়ে এলেন সুপ্রীম কোর্ট থেকে। রুদ্রনীল খুশী হলেন। ওকে আর গীতায় কোনদিন হাত রাখতে হবে না।

প্রেস কনফারেন্সে সমুদ্র সবুজ জীনস আর অস্তরাগের কমলা রঙা টী-শার্ট পরা রুদ্রনীল, পাশে সবুজ কালো অপূর্ব একটা কাতান সিল্ক পরা বসে থাকা গার্গীর শিরা বার করা ক্ষীন হাতে হাত রেখে তার স্বভাব সতেজতায় কবুল করলেন ভালবাসায় সব হয়। আর যদি সঙ্গে থাকে গার্গীর মত জীবন সঙ্গিনী তাহলে লাইফ জিঙ্গা লালা। উনি তো প্রথম থেকেই বলে এসেছেন খুন উনি করেননি। খালি সেটা বিচার ব্যবস্থার কানে তুলে, তার ঘুম ভাঙ্গাবার জন্য দরকার ছিল গার্গীর মত ক্ষুরধার কারোর । হাসিতে ফেটে পরেন সনসনী খবরের খোঁজে আসা সাংবাদিককূল। রুদ্রনীল মাথা ঝুঁকিয়ে সবাইকে অনুরোধ করেন সামান্য চা জল খাবার না খেয়ে কেউ চলে গেলে হবু-দম্পতির অকল্যাণ হবে। আবার এক মৃদু আবেশে ডুবে যান সাংবাদিককূল। ‘যাই বলুন এরম ঘটনা কি আর রোজ ঘটে?’    

বাসর রাত। বিছানায় রুদ্রনীল আধশোয়া, গার্গী বসে। দুজনেই চুপ। অবশেষে রুদ্রনীল বলেন, ‘জানি আপনি বিশ্বাস করেন খুনটা আমি করিনি’। একটু চুপ করে গার্গী বলেন, ‘আমি এমন একজন কে খুঁজছিলাম যে যুধাজিত’কে খুন করতে পারবে। বারবার আপনাকে বাঁচিয়ে আনা অনেক সময় সাপেক্ষ হবে। মেয়ে বড় হচ্ছে। তাই এবার আমার প্ল্যান আর আপনার অ্যাটিচ্যুড’। রুদ্রনীল গার্গীর ঠোঁটে ঠোট সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেওয়ার আগে অস্ফুটে বলেন, ‘মি লর্ড ছ’মাস। আপনাকে হতাশ করব না’।   

সমাপ্ত 

 

© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)

Golpo cloud, Cardiff, United Kingdom, CF24 1RE
E – golpocloud@gmail.com 

error: Content is protected !!