শব্দ . গল্প . কল্প
প্রিয় পাঠকবৃন্দ
দেখতে দেখতে এ বছরের বর্ষা প্রায় শেষের মুখে, শরৎ আসন্ন। বর্ষাকাল আসলেই একটা জিনিসের জন্যে বড্ড মনকেমন করে, ঠিক ধরেছেন, ইলিশ মাছ। যুক্তরাজ্যে থাকার জন্য আমরা যদিও সারা বছর ধরেই ইলিশ মাছের যোগান পাই। তবে বর্ষার ইলিশ বাঙালি জীবনে এমন এক অভিলাষ, যা কালজয়ী, বাঙালি DNA র এমন এক signature যা অনায়াসে বয়ে চলে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে।
সর্ষে ইলিশ, সর্ষের তেল কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পাতলা ইলিশের ঝোল, ভাপা ইলিশ – এই কথাগুলি শ্যামবাজারের বনেদি ঘটি শশীবাবু, যোধপুর পার্কের আধুনিক বাঙালি, Corporate CEO, Mrs Monalisa Ray, কানাডা প্রবাসী সুদর্শন বাগদি, কুয়েতে বসবাসকারী একাউন্টেন্ট, দাস বাবু এই সবাইকেই, থুড়ি, আমাদের সবাইকে একসূত্রে বাঁধে। সারা পৃথিবীর আপামর বাঙালির রসনা নিবৃত্তির অন্যতম প্রধান অবলম্বন – ইলিশ মাছ । আমাদের স্বাধভক্ষনে ইলিশ, নিয়মভঙ্গে ইলিশ, বিবাহে ইলিশ, জামাই ষষ্ঠীতে ইলিশ।
এহেন ‘ইলিশের’ সঙ্গে বাঙালির সখ্যতার শুরু কবে ও কিভাবে তা তর্ক ও গবেষণার সাপেক্ষ – যা বরং অন্য কোন সময়ের জন্য তোলা থাক। আমাদের আজকের আলোচ্য :
“ইলিশ মাছের সার্বজনীনতা ও চিরকালীনতা”
বর্তমান কালের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা সবাই বিভাজিত একাধিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে। প্রতিবেশী শাসমল ধরের আছে একটি দামি জাগুয়ার গাড়ি, আমার কোন গাড়ি নেই। ধীরেন গোষদস্তিদারের আছে এক সুবিশাল ছয় বেডরুম ওয়ালা বাড়ি আর হয়তো তুমি থাকো এক বেডরুমওয়ালা ফ্ল্যাটে। তোমার আছে লেটেস্ট মডেলের আইফোন, আমার কাজ চলে যাচ্ছে পাঁচ বছর পুরোনো স্যামসং দিয়ে। আমরা প্রত্যেকে আলাদা আমাদের সম্পদমূল্যের নিরিখে।
অথচ এরকম নিখুঁত পৃথকীকরণ ব্যবস্থার মাঝেও ইলিশ যেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যে কোন রূপে এক টুকরো ইলিশ পাতে পড়লেই ওই মুহূর্তটার জন্য নিজেকে খুব খুশি লাগে। নিমেষে হারিয়ে যায় না পাওয়া, না থাকার সব দুঃখ। ধীরেন ঘোষদস্তিদার আর হরিপদ কেরানি অক্লেশে সব সামাজিক দূরত্ব কাটিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনায় মেতে ওঠে – বিষয় এ মসরুমে পদ্মার ইলিশ কি পাওয়া যাবে, অথবা গঙ্গা বা কোলাঘাটের ইলিশ – কার স্বাদ বেশি ভালো।
ব্রাডলি স্টোকের দত্তগুপ্ত পরিবার, দিলীপ দত্তগুপ্ত রিটায়ার্ড প্রফেসর, স্ত্রী সরলা দত্তগুপ্ত রিটায়ার্ড গাইনোকোলজিস্ট। ষাটের দশকের মাঝামাঝি কত্তা, গিন্নি যুক্তরাজ্যে চলে আসেন জীবিকার প্রয়োজনে। দিলীপবাবুর আদি বাড়ি খুলনায়, সরলা ভবানীপুরের মেয়ে। তাদের একমাত্র মেয়ে তানিয়া জন্ম যুক্তরাজ্যে, ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। তানিয়া, বিয়ের পরে তানিয়া পাওয়েল; স্বামী জিওফ্রে ও ছেলে জোসেফ কে নিয়ে কুয়েতে থাকে। জিওফ্রে একজন অয়েল ইঞ্জিনিয়র। গত শনিবার তানিয়া ফোন করেছিল মাকে, জানতে চাইছিলো ইলিশ মাছ দিয়ে ছোলার ডাল রাঁধার রেসিপি। গেলো পুজোতে ব্রাডলি স্টোক এ এসেছিলো তানিয়ারা, সরলা জামাইকে রেঁধে খাইয়েছিলেন ‘ছোলার ডাল দিয়ে ইলিশ’। এরপর জিওফ্রে অফিস থেকে ফেরার সময় ইন্ডিয়ান কর্নারশপ থেকে একটা সোয়া কেজির বার্মিজ ইলিশ নিয়ে এসেছে। আবদার, can you please cook the same Hilsa dish, like your mum.
এরপরে মেয়ে ও মা হোয়াটস্যাপ এ ব্যস্ত হয়ে পরে ইলিশ রাধা শিখতে ও শেখাতে। সরলা ও তানিয়ার কথা শুনতে শুনতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন দিলীপ বাবু। চট করে বেরিয়ে পাশের শাহ জালাল ফুড স্টোর থেকে কিনে আনেন একটি ৬০০ গ্রামের ‘পদ্মার (খোকা) ইলিশ’। হোয়াটস্যাপ টিউটোরিয়াল এর পরে তানিয়া ব্যস্ত হয়ে ওঠে ‘মা এর মত’ ইলিশ মাছ রাঁধতে। এদিকে দিলীপ বাবুও প্রায় সেরে ফেলেছেন কাঁচালঙ্কা, কালোজিরে দিয়ে ইলিশের ঝোল।
ওপরের সবকটি চরিত্রই কাল্পনিক, কিন্তু ভীষণভাবে মিলে যায় বাঙালি জীবনের সঙ্গে। ইলিশ এক অদ্ভুত ইকুয়ালাইজার ও ইউইনিফাইয়ার, যা প্রত্যেক বাঙালির এমন এক পরিচয়কে তুলে ধরে যা ভীষণ ভাবে নিজস্ব। বড়লোক, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দেশ, বিদেশ ও আরো অনেক আর্থসামাজিক প্রভেদের মাঝে, এমন এক ঐক্য যা অমলিন, চিরকালীন। যা মনকে মেলায় মনের সঙ্গে।
গর্ব হয় বাঙালি হিসেবে, গর্ব হয় ‘ইলিশপ্রিয় ভেতো বাঙালি’ হিসেবে।
ভালো থাকবেন
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
গল্প cloud, প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক
© 2020 Golpo cloud (গল্প cloud)
Golpo cloud, KIRAN, Workbench, 15 Vanguard Way, Cardiff, CF24 5PJ
E – golpocloud@gmail.com
T – 0333 344 0046
Golpo Cloud is an initiative by the Centre for Bengali Culture and Heritage, UK, a company registered in England and Wales (Reg No – 11653547). The Centre for Bengali Culture and Heritage, UK is a project by KIRAN UK.
KIRAN is the acronym of ‘The Knowledge-based Intercommunity Relationship and Awareness Network’.
www.thekiran.org.uk
www.kiranlegal.co.uk
www.kiran.org.uk
www.golpocloud.com