55 shubha

মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করছে। টেনশনে নয় বিরক্তিতে আর ঘৃণায়। ছয়ত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় যদি এসব কথা হেয়ালির মতো কেউ বলে যায়, তখন মাথার শিরা, উপশিরা সব কিছু দপদপ করা স্বাভাবিক।

নোরা খিলখিল করে হেসেই যাচ্ছে। আশ্চর্য!  এই কথা গুলো বলার পর আমার সামনে বসে হাসতে পারছে?  আর কত সহজেই কথা গুলো বলে যাচ্ছে । আমি যে রেগে যাচ্ছি তা কি একটুও বুঝতে পারছে না!  হয়তো না কিংবা বুঝলেও ইচ্ছে করেই বলছে। সব দোষ আমারই। কেন যে কাছের মানুষ ভেবে বিশ্বাস করে বলতে গিয়েছিলাম, কাছের মানুষ গুলোই খুব সুন্দর করে নিঁখুত ভাবে পিঠ পিছনে ছুরি মারে। এখন যেমন আমার হলো।

হেই গার্ল, হোয়াই সো সিরিয়াস? জাস্ট ফান এটা।

আচ্ছা  নোরার গালে যদি ঠাস করে একটা চড় দিতে পারতাম। কেমন হতো?  আমার নাম ব্যবহার করে ঠিক আমার সাথে যার  ঝামেলা তাকে ভড়কে দিচ্ছে !  এবং  তার প্রতিক্রিয়া কি হলো তা আমায় জানাচ্ছে!  কি লজ্জা  আর কি ভয়াবহ  গ্লানি। আমি সব জেনে শুনেও কিছু  করতে পারছি না।  হায়,  আমি জেনে  শুনে করেছি বিষপান । তাছাড়া আর কি বলবো।  নোরা যাওয়ার আগে আরেক দফা হেসে বলল,  দেখেছিস আমি কত ক্রিয়েটিভ ! তোর কথার স্টাইল  এমন ভাবে কপি করেছি আর তোর তথ্য এমন ভাবে ব্যবহার করেছি ছেলেটা ভেবেই নিয়েছে এটা তুই । একদম পিওর তুই । হা হা হা….

নোরা চলে যাওয়ার পর ও ওর হাসি যেন দেয়ালে দেয়ালে ঠোকর খেয়ে আমায় ব্যঙ্গ করছে। শূন্য  বাসা আরো শূন্য  লাগছে। বাসার সবাই আজ কই যেন গ্যালো!  তীব্র  মাথা ব্যথায় সব গুলিয়ে যাচ্ছে । এ্যালসেট পাঁচ মিলিগ্রাম খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুমে চোখ বন্ধ  হয়ে আসছে আর ছবির মতো ভুল গুলো চেতনায় দোল খাচ্ছে । ঢং ঢং ঢং….

আজ থেকে এক বছর নয় মাস আগে  ঘটনার শুরু। যা সোজা ভাবা হয় তা আসলে কখনোই সোজাসাপ্টা হয় না। ওই সন্ধ্যাটা আমার জীবনে  একটা অভিশপ্ত সন্ধ্যাই ছিলো। নয়তো একটা মিথ্যা সম্পর্ক কেনো বছরের ওপর বয়ে বেড়াচ্ছি। কি হলে কি হতো জানি  না, কিন্তু  যা হওয়ার তাই হয়েছে এবং  শেষটা খুব  বাজে ভাবে হয়েছে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ও মাথাটা ধরে আছে, জানালা দিয়ে  তাকিয়ে দেখি ঝুম ঝুম বৃষ্টির ধারা। যখন ঘুমিয়েছিলাম তখন বোধহয় রোদ ছিলো আর তাপমাত্রা কত যেন ছিলো –

ফোনটা বেজেই যাচ্ছে । ধরবো না ভেবেও ধরলাম ।  ফোনের ওপাশ থেকে  মায়ের উদ্বেগ মাখা গলা – “ কিরে, কখন  থেকে ফোন করছি,  ধরছিস না কেনো?  দুপুরে খেয়েছিস?  আমাদের  ফিরতে ফিরতে রাত হবে…. টু টু টু…যাহ্, নেটওয়ার্ক  চলে গেছে আর ঠিক তার পরই চোখ ঝলসিয়ে একটা বাজ পড়ার আওয়াজ।

মন কেন আজ চঞ্চল… গুনগুন করে কফি চট করে বানিয়ে  বারান্দায় চলে এলাম। যা হবার হয়েছে -এরকম  ঝুম বৃষ্টিতে  মন খারাপ করে থাকা  অন্যায়। এ্যালসেট এর ঘোর কাটতে শুরু করেছে, কফিটা শেষ  করার আগেই  আমাকে গুরুত্বপূর্ণ  কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  

রিডিং রুমে টেবিলের উপর ফল কাটার ছুরিটা দিয়ে  আপেল কাটতে কাটতে সিদ্ধান্ত নেওয়া  শেষ  করে এক টুকরো  আপেল মুখে দিলাম। বৃষ্টি  আরো জোরেশোরে নামছে। আচ্ছা সাব্বির ভাই কে একটা ফোন দিলে কেমন হয়!  দিবো কি দিবো না ভাবতে ভাবতে আঙুল ডায়লে চলে গেলো ।

হ্যালো, নিতু?

সাব্বির ভাই  একটা কথা ছিলো-

নিতু তুমি  দশ মিনিট পরে কল দাও।

সাব্বির  ভাই  এর দশ মিনিট  পরে  কল দাও এর মানে ‘ আমি কিছুক্ষণ পর আসছি!’ আজ এই বৃষ্টিতে কি আসবে?  আমার ভয়াবহ মন খারাপের দিনগুলোতে এই ছাব্বিশ বছরের তরুণ খুব  সাবলীল ভাবে পাশে ছিলো । তারপর  যখন আমার দুঃখ দিন কেটে  গেলো উনি আস্তে আস্তে সরে গেছেন। আমি কিছু  বুঝার আগেই।  আর বুঝতে বুঝতে আমার তিন বছর লেগে গেলো! মাই গুডনেস!

সিদ্ধান্ত  এক এখন  কার্যকর হবে।  আমি আলমারি  খুলে কালো – নীল শাড়িটা নিলাম ।

চোখে কাজল দিবো কি?  হ্যাঁ কিংবা  না,  হ্যাঁ কিংবা না।  হ্যাঁ জয়যুক্ত  হয়েছে।  হালকা করে একটু  কাজল টেনে দিলাম ।

সিদ্ধান্ত  দুই  রান্না  ঘরে গিয়ে সাব্বির  ভাইয়ের পছন্দ  খিচুড়ি সাথে  বেগুন  ভাজা – বেশিক্ষণ  লাগবে না। ওয়ান… টু…থ্রী…

কলিং  বেল বাজচ্ছে নাকি হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি  পিটছে  কেউ । এখন সিদ্ধান্ত  তিন কার্যকর হবে।  আমি  স্বাভাবিক  ভাবে  দরজা খোলার চেষ্টা  করছি, কিন্তু  হাত পার্কিনসন রোগীদের মত কাঁপছে।

ইশ্,সাব্বির  ভাই  তুমি  যে  একেবারে  কাক ভেজা হয়ে গেছো।

না ভিজেই বা উপায় কি, নিয়তি যে-

মানে?

মানে কিছু  না, সামনে তখন রোগী ছিলো তাই কথা বলতে অস্বস্তি লাগছিলো। কি বলবে জানি –

আবার সেই  বুক ধুকপুক, ধ্যাত এখন কি একটা বাজ পড়তে পারে না কাছেপিঠে। চট করে কথাটা বলে ফেলতাম।

“কিসের যেন পোড়া পোড়া গন্ধ লাগছে “

এইরে,  আমি দৌড়ে রান্নাঘরে যাওয়ার আগে বললাম,  সারাজীবন আমার পোড়া খিচুড়ি খেতে পারবেন সাব্বির ভাই? 

বৃষ্টি  একবার কমে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে ঝরছে । আজ কি সব বৃষ্টি  হয়ে যাবে নাকি? 

আমি পোড়া খিচুড়ি  নামিয়ে  এসে দেখলাম সাব্বির ভাই মাথা চুলকাচ্ছে । লোকটা এমন কেনো!  আমায় দেখেই বলল ,  সারাজীবন পোড়া খিচুড়ি খাওয়ার কথা কি যেন বলছিলে?

হায় আল্লাহ ,  ডাক্তারগুলো এমন বেকুব হয় কেনো?  সরাসরিই বলতে হবে মনে হচ্ছে । সাব্বির ভাই  আপনাকে আমার ভীষণ রকম দরকার ।

কেনো? 

ধ্যাত!  মাথামোটা নাকি, না বুঝেও না বুঝার ভান করছে। বৃষ্টির শব্দে আমার কথা আড়াল হয়ে যাচ্ছে  – আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে  বললাম , কেন দরকার  বুঝেন না?  ঘরে একটা ডাক্তার  থাকলে অসুখ- বিসুখে কত সুবিধা ! আমার কান্না  পেয়ে যাচ্ছে , লোকটা যাচ্ছে তাই রকমের –

নিতু বুঝলে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম , আমার কোয়ার্টারে রান্নার কেউ  নাই, কেউ  যদি  এমন বৃষ্টি  – বাদলায় আজকের মতো পোড়া খিচুড়ি খাওয়ায় মন্দ  হয় না ।

বাইরে  বৃষ্টির তোড় কমে এল। কোথা থেকে  এক ঝলক রোদ  এসে হাজির । আর পৃথিবীর সেই  আদিম  মানব- মানবী।  দুজনে মুখোমুখি  গভীর দুখে দুখি।

error: Content is protected !!